বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির চার্জশিট চূড়ান্ত, জড়িত ৫ দেশের নাগরিক
ফাইল ছবি
বহুল আলোচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার দীর্ঘ নয় বছর পর মামলাটির চার্জশিট চূড়ান্ত হয়েছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জানিয়েছে, এই সাইবার ডাকাতিতে বাংলাদেশ ছাড়াও অন্তত আরও চারটি দেশের নাগরিক জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। শিগগিরই চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে। এটি দায়ের হলে বিশ্বের অন্যতম আলোচিত এই সাইবার ডাকাতির রহস্য উন্মোচিত হবে বলে আশা করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
সিআইডি’র তদন্তে এই বিশাল চুরির সঙ্গে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জড়িত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অভিযুক্তদের মধ্যে আন্তর্জাতিক হ্যাকার চক্রের সদস্যরা ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিভাগের তৎকালীন কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর গুরুতর গাফিলতি এবং কোনো কোনো শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা ছিল। একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক অপরাধ চক্র অত্যন্ত সুকৌশলে অত্যাধুনিক ‘ড্রিডেক্স’ (Dridex) ম্যালওয়্যার ব্যবহার করে এই অপরাধ সংঘটিত করে।
সিআইডি’র এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিভাগ থেকে সচেতনভাবেই ওই ম্যালওয়্যারযুক্ত ফাইল খোলা হয়েছিল। এরপর হ্যাকাররা নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ১০০ কোটি ডলার সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এর মধ্যে তারা ১০১ মিলিয়ন বা ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার অবৈধভাবে স্থানান্তরে সক্ষম হয়।
আরও পড়ুন: দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ৩০.৮৩ বিলিয়ন ডলার
তদন্তের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)-এর বিস্তারিত প্রতিবেদন চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই প্রতিবেদনে বিদেশি নাগরিকদের সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ রয়েছে। সিআইডি’র পক্ষ থেকে এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে এফবিআইকে প্রতিবেদনটি পাঠানোর অনুরোধ করা হয়েছে। এটি হাতে পেলেই চূড়ান্ত চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হবে।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) রাতে এই সাইবার ডাকাতি সংঘটিত হয়। হ্যাকাররা এমন একটি সময়কে বেছে নেয় যখন বাংলাদেশে ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ ছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রেও সাপ্তাহিক ছুটি শুরু হয়েছিল। চুরি হওয়া অর্থের মধ্যে প্রায় ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনে এবং প্রায় ২ কোটি ডলার শ্রীলঙ্কায় পাঠানো হয়। শ্রীলঙ্কায় পাঠানো অর্থ পরে ফেরত আনা সম্ভব হলেও ফিলিপাইন থেকে অর্থ উদ্ধার জটিল হয়ে পড়ে। দেশটির ক্যাসিনো শিল্পের গোপনীয়তা আইনের কারণে বেশিরভাগ অর্থ পাচার হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার মাত্র ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।
ঘটনার ৩৯ দিন পর ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে মামলাটি সিআইডি’র কাছে হস্তান্তর করা হয়। দীর্ঘ নয় বছরের তদন্তে শতাধিক দেশি-বিদেশি সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে এবং আইপি ঠিকানা, নেটওয়ার্ক লগ, ব্যাংক লেনদেনের তথ্য এবং ম্যালওয়্যারের কোডসহ বিস্তৃত প্রযুক্তিগত প্রমাণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, এই তদন্তের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আর্থিক অপরাধ চক্রের কৌশল এবং তাদের দেশীয় সহযোগীদের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সিআইডি’র এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা এমনভাবে চার্জশিট প্রস্তুত করছি যাতে অপরাধীরা শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিচারের মুখোমুখি হয়।
এই তদন্তে সিআইডিকে সহযোগিতা করেছে এফবিআই, ফিলিপাইনের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এনবিআই) এবং শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই সাইবার অপরাধের কৌশল ও লেনদেনের ধারা জাতিসংঘকেও জানানো হয়েছে। চার্জশিট দাখিলের পর এই ঘটনা বাংলাদেশের আর্থিক খাতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি








