পাকিস্তানে পানিবন্দি ৬ লাখ মানুষ, নিহত ১৫
ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাব এ বছর বর্ষার শুরু থেকেই ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। শতদ্রু (সুতলেজ), রাভি এবং চেনাব নদীর পানির মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে। ভারি বর্ষণ ও প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে বাঁধের পানি ছাড়া মিলিয়ে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে গড়াচ্ছে।
সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শুধু পাঞ্জাবেই এ পর্যন্ত অন্তত ১৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। সিয়ালকোট, গুজরাট, নারওয়াল, হাফিজাবাদ ও গুজরানওয়ালা জেলাগুলোতে মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। মৃতদের বেশিরভাগই বাড়িঘর ধসে, বজ্রপাতে কিংবা পানিতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন। আর দেশের অন্যান্য প্রদেশ মিলিয়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ইতোমধ্যে ৮০০ ছাড়িয়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, এর অর্ধেকই ঘটেছে চলতি আগস্ট মাসে।
ডনের প্রতিবেদন অনুসারে, বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হলো—শিয়ালকোট, নারওয়াল, হাফিজাবাদ, সারগোধা, লাহোর, কাসুর, ওকারা ও ফয়সালাবাদ। নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলো প্রায় পুরোটাই পানির নিচে। ফসলের মাঠ, ঘরবাড়ি ও যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। লাখ লাখ একর জমির ধান ও গম চাষ নষ্ট হয়ে গেছে, যা আগামী মৌসুমে খাদ্যসংকট তৈরি করতে পারে।
স্থানীয় প্রশাসন বলছে, শুধু পাঞ্জাবেই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত দেড় লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। উদ্ধারকাজে সেনাবাহিনী ও দুর্যোগ মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ (পিডিএমএ) সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। গবাদিপশু উদ্ধারের কাজও সমানভাবে চলছে—এ পর্যন্ত ৩৫ হাজারের বেশি পশু নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়েছে।
ভারতের পানিবিষয়ক কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি সুতলেজ ও রাভি নদীর কয়েকটি বাঁধের গেট খুলে দিয়েছে। এর ফলে প্রবল স্রোত নেমে আসে পাকিস্তানের ভেতরে। পাকিস্তানি গণমাধ্যম বলছে, পানির এই ঢল পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করেছে।
আরও পড়ুন: জম্মু-কাশ্মীরে ভূমিধসে মৃত ৩১, বৈষ্ণোদেবী যাত্রা স্থগিত
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রয়র্টাস ও টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, ভারতের আগাম সতর্কবার্তার কারণে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পেরেছে, যার ফলে প্রায় ১.৫–১.৬ লাখ মানুষকে সময়মতো সরানো সম্ভব হয়েছে। তবে দক্ষিণ পাঞ্জাবেও বন্যা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, এবারের বর্ষাকাল পাকিস্তানের জন্য গত বছরের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি প্রাণঘাতী হয়েছে। শুধু প্রদেশভিত্তিক নয়, সারাদেশের অবকাঠামো ও অর্থনীতিও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে।
জরুরি ত্রাণ কার্যক্রমে সহায়তা করতে জাতিসংঘ ইতোমধ্যে ৬ লাখ মার্কিন ডলার মুক্তি দিয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও বিভিন্ন দাতা দেশও পাকিস্তানের দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।
আবহাওয়াবিদ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দক্ষিণ এশিয়ার মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও নদীস্রোতের এ ধরনের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি জলবায়ু পরিবর্তনেরই বহিঃপ্রকাশ। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ফলে পাকিস্তান প্রতিবছরই ভয়াবহ বন্যার শিকার হচ্ছে।
গত বছরও দেশটিতে বড় ধরনের বন্যা হয়েছিল, তবে এবার মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আগের তুলনায় বহুগুণ বেশি। ভবিষ্যতে একই ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো, উন্নত বাঁধ ব্যবস্থাপনা ও আঞ্চলিক সমন্বিত পদক্ষেপের বিকল্প নেই।
পাঞ্জাবের এই ভয়াবহ বন্যা আবারও প্রমাণ করল—প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুধু একটি দেশের সমস্যা নয়, বরং তা পুরো অঞ্চলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। সীমান্ত পারাপারের নদীগুলোর ভাগাভাগি ও যৌথ ব্যবস্থাপনা ছাড়া এমন পরিস্থিতি আরও ঘন ঘন ঘটতে পারে। এখনই যদি সরকার ও আন্তর্জাতিক মহল সমন্বিত উদ্যোগ না নেয়, তাহলে এ ধরনের বন্যা আগামী দিনে আরও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নেবে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি








