রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি ১১ দেশের
ছবি: সংগৃহীত
আজ থেকে ঠিক আট বছর আগে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর ভয়াবহ দমন-পীড়নের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। এই দীর্ঘ আট বছরে তাদের মানবিক সংকট আরও গভীর হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের কক্সবাজারে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে, যাদের মধ্যে অর্ধেকই শিশু। এই সুবিশাল শরণার্থী শিবিরগুলো এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে।
এই মানবিক সংকটের অষ্টম বর্ষপূর্তিতে অষ্টম বর্ষপূর্তির দিনে সোমবার (২৫ আগস্ট) আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নতুন করে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেছে।
পশ্চিমা বিশ্বের ১১টি দেশ বাংলাদেশের প্রতি তাদের জোরালো সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। এই দেশগুলো হলো অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, যুক্তরাজ্য, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও ফিনল্যান্ড।
ফ্রান্স দূতাবাস তাদের অফিশিয়াল এক্স (টুইটার) ও ফেসবুক পেজে এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা এবং বাংলাদেশের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে সংকট সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ৭ দফা প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার
যৌথ বিবৃতির মূল বিষয়গুলো
- বিশাল আশ্রয় ও মানবিক সংকট: বর্তমানে বাংলাদেশে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে, তবে নতুন করে আগমন এখনো চলছে। কক্সবাজারের ৩৩টি ক্যাম্পে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে, যাদের অর্ধেকই শিশু। বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিনের সহনশীলতা ও দৃঢ়তাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্মান জানিয়েছে।
- বাংলাদেশের অবদান: সীমিত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আশ্রয়, নিরাপত্তা ও জীবনরক্ষাকারী মানবিক সহায়তা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। স্থানীয় জনগণের অবদানকেও উচ্চভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে।
- প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা: মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি এখনো এমন নয় যে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে ফেরত পাঠানো সম্ভব। তাই প্রত্যাবাসনের নির্দিষ্ট কোনো সময়সূচি ঘোষণা করা যাচ্ছে না।
- সহিংসতার নিন্দা: মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সহিংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে। অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করা ও মানবিক সহায়তার জন্য নিরাপদ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের জন্য দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
- দীর্ঘমেয়াদি সমাধান: তহবিল সংকট বাড়তে থাকায় রোহিঙ্গাদের আত্মনির্ভরশীলতা, কর্মসংস্থান ও শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি তহবিল ঘাটতির কারণে বহু লার্নিং সেন্টার বন্ধ হয়ে গেছে, যা শিশুদের শিক্ষাকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
- ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণ: বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে, যাতে তারা বাংলাদেশে অবস্থানকালে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে।
ফ্রান্স দূতাবাস তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সংকটের মূল কারণ সমাধানে বদ্ধপরিকর এবং শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে সফল করতে সম্মিলিতভাবে কাজ করবে।
একই দিনে কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক সংলাপ শুরু হয়, যেখানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস উপস্থিত ছিলেন। তিনি রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সাত দফা প্রস্তাব দেন। এর মধ্যে ছিল—বৈশ্বিক রোডম্যাপ প্রণয়ন, দাতাদের সহায়তা নিশ্চিতকরণ, আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সক্রিয় ভূমিকা এবং আন্তর্জাতিক জবাবদিহি জোরদার করা।
আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে একটি উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন বসবে। সেখানে প্রত্যাবাসনের রোডম্যাপ, মানবিক তহবিল পুনরুদ্ধার এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জবাবদিহির বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাবে।
বর্ষপূর্তির দিনে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গারা মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। তাদের প্রধান দাবি ছিল—“No more refugee life”, “Repatriation the ultimate solution।” আশ্রয়প্রার্থীদের অভিযোগ, বাংলাদেশে আট বছর কাটানোর পরও তারা এখনো অনিশ্চিত জীবনযাপন করছে।
আট বছর পূর্তিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নতুন প্রতিশ্রুতি রোহিঙ্গাদের জন্য আশার বার্তা নিয়ে এলেও বাস্তবতা বলছে, প্রত্যাবাসনের পথে এখনও বহু বাধা রয়েছে। মিয়ানমারের স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎই তাদের ফেরার একমাত্র নিশ্চয়তা হতে পারে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি








