ভুয়া ভাউচারে অর্থ আত্মসাৎ, আদালতের আদেশ মানেন না শিক্ষকনেতা মামুন
কমিটি গঠন কার্যক্রমে আদালতের স্থগিতাদেশ অমান্য করে মনোনয়পত্র বিক্রি করেন শিক্ষক মামুন। ছবি: সংগৃহীত
উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ অমান্য করে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির (নিয়মিত) নির্বাচনের মনোনয়নপত্র বিক্রি করছেন টাঙ্গাইল সদর উপজেলার আজিম মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুন।
তিনি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপারভাইজার ফরুক আহমেদের পাঠানো চিঠির ভিত্তিতে তিনি এই কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
এর আগে আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ইউক্যালিপটাস গাছ রোপণের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত হয়েছিল।
মাউশির পরিপত্র, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ (মাউশি) গত ৮ সেপ্টেম্বর একটি পরিপত্র জারি করে চলতি বছরের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ম্যানেজিং কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয় এবং ১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব অ্যাডহক কমিটি বিলুপ্ত করার কথা বলা হয়। কিন্তু উচ্চ আদালত ২১ অক্টোবর এই কার্যক্রম স্থগিত করে আদেশ জারি করেন।

আদালতের নির্দশনার দুইদিন পরই কমিটি গঠনের নির্দশনা দেন ফারুক
তথ্য অনুসারে, আদালতের স্থগিতাদেশের মাত্র দুই দিন পর, ২৩ অক্টোবর, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপারভাইজার ফরুক আহমেদ স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে আজিম মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ে মনোনয়নপত্র বিক্রির নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুন ২৮ অক্টোবর থেকে মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করেন এবং জমা দেওয়ার শেষ দিন নির্ধারণ করেন ৩০ অক্টোবর।
উপজেলা শিক্ষা অফিসের নির্দেশনা পায়নি অন্য স্কুলগুলো
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এলাকায় অন্য কোনো স্কুলে নিয়মিত ম্যানেজিং কমিটি গঠন করতে এমন কোনো চিঠি দেয়নি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস। একই এলাকার আরও তিনটি বিদ্যালয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, তারা উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে নিয়মিত কমিটি গঠনের বিষয়ে কোনো লিখিত নির্দেশনা পাননি। নিউজবাংলাদেশের অনুসন্ধানে মনোনয়নপত্র বিক্রির প্রমাণপত্র ও ছবি পাওয়া গেছে, যেখানে দেখা যায় প্রধান শিক্ষক নিজেই এই কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
মাউশি আগে কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল: প্রধান শিক্ষক মামুন
প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “মাউশি থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নিয়মিত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আমরা সেই নির্দেশেই মনোনয়ন বিক্রি শুরু করেছি।”
আদালতের স্থগিতাদেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, “ এটা জানি তবে এই বিষয়ে আমরা মাউশির কোনো পরিপত্র পাইনি। ইউএনও প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগ দেন, বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে আপনাকে জানাব।”
উচ্চ আদালতের নির্দেশ অবজ্ঞা করে মনোনয়পত্র বিক্রি আদালত অবমাননা কিনা এমন প্রশ্নের জাবাবে মামুন বলেন, “ইউএন স্যারের সাথে কথা বলে দেখি কি করা যায়।”
ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেবো: ইউএনও
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুজিবুল আহসান বলেন, “আদালতের নির্দেশনার বিষয়ে আমরা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি, তবে এখনো কোনো মাউশির চিঠি পাইনি।”
নিয়মিত কমিটি গঠনের কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়া আদালতের আদেশ অমান্য করে একটি স্কুলে মনোনয়প্রত্র বিক্রি আদলত অবমাননা কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ইউএনও বলেন, “এ বিষয়ে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেবো।”

প্রধান শিক্ষক মামুনের বিরুদ্ধে আগেও অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল
প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে এর আগেও একাধিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বিদ্যালয়ের করণিক জহিরুল তার স্থানীয় বাজারে কম্পিউটারের দোকানে প্রধান শিক্ষকের যোগসাজসে সনদ ও প্রসংসাপত্র তৈরি করে বিক্রি করে বিক্রি করে আসছে বলে অভিযোগ আছে। সম্প্রতি সে অভিযোগ এলাকাবসীর সামনে স্বীকারও করেছেন। বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী-এলাকাবাসী তার বিরুদ্ধে স্কুলের কোষাগার থেকে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন এবং কর্মচারী নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, গাছ কেটে অর্থ আত্মসাৎ, বাউন্ডারি নির্মাণে অনিয়েমের অভিযোগ এনেছেন।
বাড়িঘরে আগুন, লুটপাটের নির্দশদাতা শিক্ষক মামুন
কয়েক বছর আগে মাছ ধরাকে কেন্দ্র প্রধান শিক্ষক মামুনের প্রিয়ভাজন শিক্ষক সুবীর চন্দ্র রায়ের সঙ্গে একই এলাকার আক্কাস আলী নামে এক যুবকের মারামারির জেরে মানববন্ধন থেকে আক্কাসের পরিবারের সদস্যদের কুপিয়ে আহত করা হয়। ভাঙ্গচুর ও লুটপাটের পর বাড়িঘর আসবাবপত্র, মোটরসাইকেল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। মানবন্ধন থেকে আজিম মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মামুন এর নির্দেশনা দেন বলে জানায় ভুক্তভোগী আক্কাসের বাবা নূরুল ইসলাম ও তার ছেলে আশরাফ ও পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনায় আব্দুল্লাহ আল মামুন ও সুবীর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের একটি মামলা আদালতে বিচারাধীন আছে।
ভুয়া ভাউচারে ১১ লাখ টাকা আত্মসাত করেন শিক্ষক মামুন ও সুবীর
অডিট পর্যালোচনা কমিটির একাধিক সদস্য জানান, প্রধান শিক্ষক মামুন ও শিক্ষক সুবীর চন্দ্র রায় ভুয়া ভাউচার তৈরি করে ২০২২-২০২৩ সাল ২ বছরে বিদ্যালয়ের তহবিল হতে প্রায় ১১ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন। প্রধান শিক্ষক, শিক্ষক সুবীর ও সহযোগী করণিক জহিরুলের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর বিদ্যালয়ের অর্থ আতসাতের অভিযোগ ও আন্দোলন সময় বিদ্যালয়ের তৎকালীন সভাপতি ওয়ালটন গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যা নূরুল আলম রেজভী এলাকাবাসীকে নিয়ে বসে একটি অডিট কমিটি করে দেন। সেই কমিটি প্রধান শিক্ষক মামুন ও শিক্ষক সুবীর চন্দ্র রায়ের ভুয়া ভাউচার তৈরি করে প্রায় ১১ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে বলে এলাকাবাসী নিয়ে এক সভায় জানিয়েছে। সেখানে প্রধান শিক্ষক মামুন ও সুবীর রায় উপস্থিত ছিলেন।
একইসঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ বাণিজ্য হয়েছে যাতে শিক্ষক মামুনসহ কয়েকজন জড়িত আছেন বলে তারা জানতে পেরেছেন। বিষয়টির সমাধান প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানান তারা।

আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে প্রধান শিক্ষক মামুনের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ইউক্যালিপটাস গাছ রোপণের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত হয়।
বিজ্ঞানাগারে যন্ত্রপাতি কেনার ১ লাখ টাকার পুরোটাই শিক্ষক মামুনের পকেটে
অডিট কমিটির সদস্য মোতাহারুল হক জানান, ২০২২৩-২০২৩ সালে বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানাগারের জন্য যন্ত্রপাতি কিনতে ১ লাখ টাকার অনুদান দেয় মন্ত্রণালয়। কিন্তু যন্ত্রপাতি না কিনে ভুয়া ভাউচার দেখিয়ে পুরো ১ লাখ টাকাই আত্মসাত করেছেন প্রধান শিক্ষক। ১ লাখ টাকার বিল বলে যে কাগজ কমিটিকে দেয়া হয় মূলত তা কোনো বিল নয়- এটি একটি দোকানের কোটেশন। আমরা ওই দোকান মালিক আনোয়ারের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি, এ নামে তার কোনো দোকানের ট্রেড লাইসেন্স নেই, কোনো বিল করার প্রশ্নই ওঠে না। এক সভায় শিক্ষক সমিতির সহ সভাপতি মনিরুজ্জামনের উপস্থিতিতে প্রতিবেদন আকারে প্রধান শিক্ষক মামুন, সুবীর চন্দ্র রায় ও জহিরুলের দুর্নিতীর ্এসকল তথ্য প্রতিবেদন আকারে এলাকাবাসীর সামনে প্রকাশ করেন।
দুর্নিতীর অভিযোগ নিয়ে যা বললেন মামুন
প্রধান শিক্ষক মামুনের বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ের তহবিল হতে ভুয়া ভাউচার দেখিয়ে অর্থ আত্নসাতের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এসব অভিযোগের কিছু কিছু সত্য। ভুল হতে পারে। অডিটে প্রমাণ পেলে ফেরত দেবো। তাছাড়া সব অভিযোগের বিষয়ে অডিট পর্যালোচনা কমিটির আহবায়কের কাছে বলেছি।
স্থানীয়-অভিভবকের মতামত
নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। স্কুল কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ না থাকায় শিক্ষার্থীরা শিক্ষার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে এবং বিদ্যালয়ের সম্পদ ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
এই ঘটনায় স্থানীয় শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সচেতন মহলে তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। তারা মনে করছেন, আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে পরিচালিত কার্যক্রম বিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ণ এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে প্রধান শিক্ষক মামুন, সুবীর ও করণিক জহিরুল। তাদের দুর্নিতীর যথাযথ শাস্তি দাবি করে তারা বলেন, শিক্ষক যখন এলাকার সাধারণ দরিদ্র, কৃষক- শ্রমিক অভিভাবকদের দেয়া টাকা ভুয়া ভাউচার দেখিয়ে চুরি করে তখন তাদের কাছে আমাদের ছেলে মেয়েরা কি শিখবে?
তাছাড়া তিনি উপজেলা শিক্ষক সমিতির নেতা হওয়ায় যা ইচ্ছা তাই করেন। এমনকি কমিটির লোকজনকেও কোনো গুরুত্ব দেন না বলে জানান অভিভাবকরা।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি/এনডি








