স্বার্থ হাসিলের নতুন হাতিয়ার ‘মব জাস্টিস’

ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে মব জাস্টিস বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে বিচার কার্যক্রমের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। আওয়ামী লীগ সমর্থন, চুরির অপবাদ, পোশাকের অজুহাতে নারী হেনস্তা কিংবা ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মানুষকে প্রকাশ্যে হত্যা, এমনকি কবর থেকে লাশ তুলে পুড়িয়ে ফেলার মতো নৃশংসতা এখন যেন নিয়মিত খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে—বাংলাদেশ কি “মবের মুল্লুকে” পরিণত হচ্ছে?
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, মব জাস্টিস হলো জনতার হাতে আইন তুলে নিয়ে বিচার করার প্রবণতা। এটি বহু দেশে দেখা গেলেও বাংলাদেশে এর মাত্রা ভয়াবহ। উত্তেজিত জনতা বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাউকে শাস্তি দেয়, যা প্রায়শই মারধর, নির্যাতন বা হত্যার রূপ নেয়।
বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রবণতার পেছনে রয়েছে বিচার বিভাগের দুর্বলতা ও ধীরগতি, আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য, রাজনৈতিক উত্তেজনা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, গুজব ও মিথ্যা তথ্যের বিস্তার।
এর পরিণতি ভয়াবহ—আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়, নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারায়, এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত সময়ে দেশে মব সহিংসতায় ২০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এই পরিসংখ্যান দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে এবং সামাজিক কাঠামোর জন্য গুরুতর হুঁশিয়ারি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
মব নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রবল সমালোচনা উঠেছে। অধিকাংশ ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তা জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মবের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি না হওয়ায় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলো নিজেদের স্বার্থে মব তৈরি করছে, যা দেশে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, মবের মাধ্যমে মানুষকে নাজেহাল ও হত্যা করে সমাজে ভয় সৃষ্টি করা হচ্ছে। সম্প্রতি একজনের লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সদস্যরাও মব-আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় ট্রাফিক দায়িত্ব পালনকালে এক পুলিশ কনস্টেবলকে মারধর করে মব। পরদিন আদাবরের সুনিবিড় হাউজিং এলাকায় এক পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে আহত করে সন্ত্রাসীরা। এমন ঘটনায় সাধারণ মানুষসহ পুলিশও নতুন করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উমর ফারুক বলেন, পুলিশকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে হবে। তারা যেন আইনের ভেতর থেকে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করতে পারে, সেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, যারা মব তৈরি করে দেশকে ধ্বংস করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই। এমনভাবে প্রতিরোধ করতে হবে যাতে অন্যরা সাহস না পায়।
কিছু বিশেষজ্ঞ এমনকি পুলিশের আত্মরক্ষার্থে ‘পায়ে গুলি’ নীতির প্রস্তাব দিয়েছেন, যাতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ডিসি (মিডিয়া) তালেবুর রহমান জানান, পুলিশ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। ঢাকায় শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মবকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন বলেন, মব জাস্টিসে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। পুলিশ কঠোর হলে মব মুহূর্তেই ছত্রভঙ্গ হবে।
বাংলাদেশে মব জাস্টিস এখন কেবল অপরাধীদের নয়, পুলিশ সদস্যদের জীবনকেও ঝুঁকিতে ফেলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা, শাস্তির অভাব এবং সামাজিক অসহিষ্ণুতা এই প্রবণতাকে আরও উসকে দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের সাহসী ও কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া এই নৈরাজ্য ঠেকানো সম্ভব নয়।
এই সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজন শক্তিশালী আইন প্রয়োগ, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, সামাজিক সচেতনতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা। নইলে এই নৈরাজ্য আরও গভীর হবে, এবং তার মূল্য দিতে হবে পুরো সমাজকে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি