অস্ত্রবিরতির মধ্যেই গাজায় নতুন ইসরায়েলি হামলা
 
									ফাইল ছবি
অস্ত্রবিরতি পুনরায় কার্যকর রাখার ঘোষণা দিয়েও ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নতুন করে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।
বুধবার (২৯ অক্টোবর) সন্ধ্যায় উত্তর গাজার বেইত লাহিয়ায় চালানো হামলায় অন্তত দুইজন নিহত হয়েছেন। এর আগে মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) রাতের হামলায় নিহত হয়েছিলেন শতাধিক মানুষ—যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
এমন অবস্থায় শান্তি প্রচেষ্টাকে ‘হাতছাড়া না করতে’ সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা।
আল-শিফা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বুধবার সন্ধ্যার ওই হামলায় দুইজন নিহত হন এবং আরও কয়েকজন আহত হন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, হামলাটি চালানো হয়েছিল এমন একটি স্থানে, যেখানে অস্ত্র মজুত ছিল এবং যা তাদের সেনাদের জন্য “তাৎক্ষণিক হুমকি” তৈরি করেছিল।
এই হামলা কার্যত গাজার নাজুক অস্ত্রবিরতিকে নতুন করে অনিশ্চয়তায় ফেলেছে। এর আগে মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) দক্ষিণ গাজার রাফাহ এলাকায় এক ইসরায়েলি সেনা নিহত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ‘প্রতিশোধমূলক জোরালো হামলার’ নির্দেশ দেন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ওই হামলায় ১০৪ জন নিহত হন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। ইসরায়েল দাবি করে, হামাসের সিনিয়র যোদ্ধাদের লক্ষ্য করেই তারা অভিযান চালায় এবং ‘ডজনখানেক যোদ্ধা’ নিহত হয়েছে।
বুধবার দুপুরে ইসরায়েল আবারও যুদ্ধবিরতি কার্যকর রাখার ঘোষণা দেয়, কিন্তু একইদিন সন্ধ্যায় পুনরায় হামলা চালায়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, সর্বশেষ হামলা সত্ত্বেও অস্ত্রবিরতি “ঝুঁকির মুখে নেই”। অন্যদিকে মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতার হামলায় গভীর হতাশা প্রকাশ করলেও জানিয়েছে, তারা এখনও যুদ্ধবিরতির পরবর্তী ধাপের বিষয়ে আশাবাদী।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফান ডুজারিক এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, গুতেরেস গাজার বেসামরিক জনগণের ওপর ইসরায়েলি বিমান হামলার নিন্দা জানিয়েছেন— বিশেষ করে শিশুহত্যা ও নারী-নিপীড়নের ঘটনাগুলোর কারণে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফলকার তুর্ক বলেন, এত বিপুল সংখ্যক হতাহতের খবর “ভয়াবহ”। শান্তির সুযোগ যেন “হাতছাড়া না হয়” সে বিষয়ে সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। একই ধরনের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও।
হামাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, রাফাহে যে ঘটনায় এক ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছিলেন, সেটির সঙ্গে তাদের যোদ্ধাদের “কোনও সম্পর্ক নেই”। তারা অস্ত্রবিরতি মানার অঙ্গীকারও পুনর্ব্যক্ত করেছে।
আরও পড়ুন: গাজায় ফের শক্তিশালী হামলার নির্দেশ নেতানিয়াহুর
তবে সাম্প্রতিক হামলার কারণে এক মৃত ইসরায়েলি বন্দির মরদেহ ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি।
হামাস জানিয়েছে, ইসরায়েলের নতুন হামলা অব্যাহত থাকলে সেটি “বন্দিদের মরদেহ উদ্ধার অভিযানে গুরুতর বাধা সৃষ্টি করবে।”
অন্যদিকে ইসরায়েল রেডক্রস প্রতিনিধিদের ফিলিস্তিনি বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করেছে, দাবি করে যে এমন সাক্ষাৎ “নিরাপত্তা ঝুঁকি” তৈরি করতে পারে। হামাস এটিকে বন্দিদের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিয়েছে।
দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রান্সেসকা আলবানিজ সম্প্রতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পেশ করা ২৪-পাতার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, পশ্চিমা শক্তি এবং কিছু আরব রাষ্ট্রসহ ষাটেরও বেশি দেশ গাজায় ইসরায়েলের “গণহত্যার যন্ত্র” সচল রাখতে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে।
‘গাজা গণহত্যা: এক যৌথ অপরাধ’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে তিনি বলেন, ওয়াশিংটন ও বার্লিন থেকে শুরু করে লন্ডন ও তারও বাইরে পর্যন্ত সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক যোগসাজশের এক বিশাল জাল বিস্তৃত। এই সহযোগিতার ফলেই দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষ অনাহার, অবরোধ ও বোমা হামলার মধ্যে ধ্বংস হচ্ছে।
তিনি উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের অস্ত্র আমদানির দুই-তৃতীয়াংশ জোগান দেয় এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সাতবার ভেটো প্রয়োগ করে ইসরায়েলকে দায়মুক্তি দিয়েছে।
জার্মানি, ব্রিটেন ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশও উন্নত অস্ত্র সরবরাহ করেছে, যদিও “গণহত্যার প্রমাণ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছিল।”
আরব দেশগুলোর সমালোচনাও করে আলবানিজ বলেন, গাজা জ্বলতে থাকলেও কিছু আরব রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। মিশরের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশটি রাফাহ সীমান্ত বন্ধ রেখে গাজার শেষ মানবিক জীবনরেখাটিকেও চেপে ধরেছে।
প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় ইসরায়েলি দূত ড্যানি দানন আলবানিজকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে “দুষ্ট ডাইনি” বলে গালিগালাজ করেন। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা তার এই আচরণকে “অশোভন ও লজ্জাজনক” বলে নিন্দা জানান।
প্রতিক্রিয়ায় অবিচল আলবানিজ বলেন, যদি আপনারা আমার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হিসেবে জাদুবিদ্যার কথা বলেন, আমি তা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু যদি সত্যিই আমার কোনো মন্ত্রশক্তি থাকত, আমি তা ব্যবহার করতাম আপনাদের অপরাধ থামাতে।
তিনি রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানান— ইসরায়েলের সঙ্গে সব সামরিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্থগিত করতে, বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে এমন “দ্বৈত-ব্যবহারযোগ্য পণ্য” বিনিময় বন্ধ করতে।
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা তার এই প্রতিবেদকে গাজার যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে প্রকাশিত সবচেয়ে কঠোর ও স্পষ্ট অভিযোগপত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
এদিকে, গাজা যুদ্ধের চাপ ইসরায়েলি সেনাদের মানসিক সংকটকেও প্রকট করে তুলেছে। ইসরায়েলি পার্লামেন্ট নেসেটের রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সেন্টার প্রকাশিত নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত অন্তত ৫০ জন সেনা আত্মহত্যা করেছেন, আর আরও ২৭৯ জন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর গাজায় ব্যাপক রিজার্ভ সৈন্য সমাবেশের মধ্যেই এই আত্মহত্যার হার বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আত্মহত্যাকারীদের ৭৮ শতাংশই ছিলেন যুদ্ধরত সেনা— যেখানে ২০১৭-২০২২ সময়কালে এই হার ছিল মাত্র ৪২-৪৫ শতাংশ।
ইসরায়েলি সামরিক মেডিক্যাল কর্পসের মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গাজা যুদ্ধের সহিংসতা ও মানসিক আঘাতই সেনাদের মধ্যে আত্মঘাতী প্রবণতা বাড়িয়েছে। যদিও সেনাবাহিনী এসব ঘটনা গোপন রাখার চেষ্টা করছে, একের পর এক তথ্য ফাঁস হয়ে সংকটের গভীরতা উন্মোচিত করছে।
অস্ত্রবিরতির ঘোষণার পরও পুনরায় গাজায় ইসরায়েলের হামলা কেবল যুদ্ধের অচলাবস্থাই নয়, মানবিক বিপর্যয়কেও আরও গভীর করে তুলেছে। জাতিসংঘের আহ্বান, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থার সতর্কবার্তা—সবকিছুই এখন এক প্রশ্নে এসে ঠেকেছে:
শান্তি কতটা বাস্তব, আর যুদ্ধবিরতি কতটা টেকসই?
সূত্র: আল জাজিরা
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি






































