‘নির্বাচন বানচালের চেষ্টা, প্রস্তুত প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনী’
ফাইল ছবি
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন বানচালের উদ্দেশ্যে দেশি ও বিদেশি শক্তি সক্রিয় হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেছেন, ছোটখাটো নয়, বড় শক্তি নিয়ে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করা হবে। হঠাৎ আক্রমণও আসতে পারে। এই নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে। তবে যত ঝড়ঝাপটা আসুক না কেন, আমাদের তা অতিক্রম করতে হবে।
বুধবার (২৯ অক্টোবর) রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এ মন্তব্য করেন।
এদিন বিকেলে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বৈঠকের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
প্রেস সচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যে ‘আক্রমণ’-এর কথা বলেছেন, তা শুধু শারীরিক নয়, বরং সাইবার আক্রমণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া বা অপতথ্য ছড়ানোর বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত। পতিত স্বৈরাচার ও তার দোসররা দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, তা চায় না। সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
বৈঠকে মূলত চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়—(১) সমাজমাধ্যমে ভুয়া ও অপতথ্য নিয়ন্ত্রণ, (২) নির্বাচনকালীন মাঠ প্রশাসনের পদায়ন, (৩) নির্বাচনী প্রশিক্ষণ, এবং (৪) সার্বিক নিরাপত্তা।
প্রেস সচিব জানান, গত তিনটি নির্বাচনে যাদের সামান্যও সংশ্লিষ্টতা ছিল, তাদের এবার পদায়ন করা হবে না। পদায়নের ক্ষেত্রে কর্মকর্তার দক্ষতা, বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন (এএসআর), রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড, শারীরিক সক্ষমতা ইত্যাদি বিবেচনা করা হবে। কেউ নিজ জেলা বা শ্বশুরবাড়ির এলাকায় পোস্টিং পাবেন না। কোনো কর্মকর্তার আত্মীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তাও পদায়নে প্রভাব ফেলবে।
আরও পড়ুন: জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসছে ইইউর পূর্ণাঙ্গ মিশন
সবচেয়ে যোগ্য ও সক্ষম কর্মকর্তাদের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় দায়িত্ব দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীর ৯২ হাজার ৫০০ সদস্য নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে—এর মধ্যে ৯০ হাজার সেনা ও বাকি অংশ নৌবাহিনীর সদস্য। প্রতিটি জেলায় এক কোম্পানি সেনা সদস্য মোতায়েন থাকবে।
নির্বাচনকালীন দায়িত্বে থাকা আনসারসহ সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করতে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। প্রবাসী, কারাবন্দি ও নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের ভোট প্রদানের সুযোগ দিতে একটি বিশেষ অ্যাপ তৈরি করা হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য বা অপপ্রচার মোকাবিলায় দুটি পৃথক কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কাজ করবে। এসব কমিটি তাৎক্ষণিকভাবে ছড়িয়ে পড়া তথ্য যাচাই করে সত্যতা প্রকাশ করবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
প্রেস সচিব আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা সতর্ক করেছেন যে নির্বাচন বানচালের জন্য দেশি-বিদেশি শক্তি বিভিন্নভাবে অপপ্রচার চালাবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মিথ্যা ছবি ও ভিডিও ছড়ানো হতে পারে। এসব মোকাবিলায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে—অপপ্রচার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি ঠেকাতে হবে, যাতে ছড়াতে না পারে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, একটি সুন্দর ও উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজন করতে হলে জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবে। মানুষকে জানাতে হবে নির্বাচনী নীতিমালা, ভোটকেন্দ্রের নিয়মাবলি, কীভাবে ভোট দিতে হয় এবং কোথাও বিশৃঙ্খলা হলে করণীয় কী।
এ জন্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে আরও বেশি টিভিসি, ডকুমেন্টারি ও ভিডিও প্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় সংহতি ও প্রতিরক্ষাবিষয়ক বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবদুল হাফিজ, বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া, নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার হোসেন, স্বরাষ্ট্র সচিব ড. নাসিমুল গনি, পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম, র্যাব মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান, কোস্টগার্ড মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল জিয়াউল হক এবং বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকীসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে একই দিন সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে আট খণ্ডের চূড়ান্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। প্রতিবেদনে কমিশনের সব সভা, সুপারিশ ও কার্যবিবরণী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এ সময় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এই প্রতিবেদন সাধারণের জন্য সহজবোধ্যভাবে বই আকারে প্রকাশ করতে হবে, যাতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও তা পড়ে বুঝতে পারে এবং অন্যদের জানাতে পারে। বইটি বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষায় প্রকাশ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে এই বইটি যেন শিক্ষার্থীদের অবশ্যপাঠ্য হয়ে ওঠে, সেটি বিবেচনায় রাখতে হবে। তরুণ প্রজন্ম জানবে, পড়বে, এবং তাদের বাবা-মাকেও জানাবে বইটিতে কী আছে।
প্রতিবেদন হস্তান্তরকালে উপস্থিত ছিলেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ, কমিশন সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
প্রফেসর আলী রীয়াজ জানান, আট খণ্ডের প্রতিবেদনে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫, কমিশনের কার্যক্রমের প্রক্রিয়া, প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক দলগুলোর লিখিত প্রস্তাবনা, সাধারণ মানুষের মতামত এবং সব আলোচনাসহ সংলাপের পূর্ণ বিবরণ সংরক্ষিত রয়েছে। আমাদের বিশ্বাস—ভবিষ্যতে এটি দেশে-বিদেশে গবেষণার এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে উঠবে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি








