দা-বটিতে শান দিয়েই চলে ভূমিহীন আমিরুলের সংসার

ছবি: নিউজবাংলাদেশ
পুরোনো কাঁচি,বটি,চাকু কিংবা দা ধার (শান) দিয়ে ব্যবহার উপযোগী করাই তার কাজ। গ্রামের ভাষায় ধার করার (শান দেওয়া) এই মেশিনের নাম শান মেশিন। নিজের তৈরি এই শান মেশিনে প্রতিটি পাড়া মহল্লায় এবং বিভিন্ন হাট বাজারে গত ৩৫ বছর ধরে গিয়ে শান দেওয়ার কাজ করে সংসার চালিয়ে আসছেন লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার একজন ষাটোর্ধ বয়সের ভূমিহীন আমিরুল ইসলাম।
কখনো বাই সাইকেল, আবার কখনো চার্জার অটোরিক্সায় জীবিকার তাগিদে হাট বাজারে বেরিয়ে পড়েন তিনি। এই কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়েই অনেক কষ্টে পরিবারের ভরণ পোষন চলে তার। শেষ বয়সে এসে বসবাস করতে হচ্ছে ছেলের কেনা জমিতে। তাও আবার দুর্বিষহ অবস্থা। নেই মাথাগোঁজার ভালো ঠাইটুকুও। তবুও নিরুপায় হয়ে সেখানেই বাস করছেন।
উপজেলার ভোটমারী ইউনিয়নের ভূল্ল্যারহাট ডাঙ্গাপাড়া ৩ নং ওয়ার্ডের মৃত ছমির উদ্দিন পাইকারের ছেলে আমিরুল ইসলাম। তার নিজের বলতে কিছুই নেই, ছেলের জমিতে একপাশে ঘর করে রাত্রি যাপন করেন তিনি।
মঙ্গলবার সরেজমিনে কালীগঞ্জের কাকিনা বাজারে দেখা যায় আমিরুল শান দেওয়া মেশিনটির চাকা ঘুরিয়ে শান দিচ্ছে। এতে একটি পাথরের প্লেট সজোরে ঘুরাতে হচ্ছে তাকে। ঘূর্ণায়মান ওই পাথরের প্লেটের কার্ণিশে লোহার চাকু,দা ও কাঁচি স্পর্শ করলে ঘর্ষণে ধার উঠে যায়। এসময় ঘর্ষণের ফলে আগুনের ফুলকিও বের হয়। এই আগুনের ফুলকি ছিটকে আসে, যা শরীর ও চোখের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এভাবে দুই পায়ে প্যাডেল ঘোরানোর কাজ খুবই পরিশ্রমের। শরীর না কুলালেও জীবিকার তাগিদে তাকে শান দেওয়া মেশিনের প্যাডেল ঘোরাতে হচ্ছে।
আমিরুল বলেন, দরিদ্র পরিবারের সন্তান হিসেবে কখনো স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বাল্যকাল হতেই জীবিকার তাগিদে পরের ক্ষেতে কামলা (দিন হাজিরায়) খেটে সংসারে আয় উপার্জন করতে হয়েছে। যখন ২৫ বছর তখন থেকেই একটি শান দেওয়া মেশিন কাটের ফ্রেমে তৈরী করে শুরু করেন গ্রামে-গঞ্জে হাট বাজারে গিয়ে মরচে ধরা পুরানো কাচি, দা ও চাকুতে ধার ওঠানোর কাজ। পরে পুরাতন বাইসাকেল কিনে সেটাতে শান দেয়ার পাথর সেটিং করে ৩৫ বছর ধরে সেই মেশিনেই চলছে এ কাজ। বর্তমানে একটি চার্জার অটোতে করে ঘুরেন হাট বাজারে। প্রতিদিন গড়ে ৩০০/৩৫০ টাকা আয় হয়। এ আয় দিয়েই চলছে পরিবারের ভরন পোষণ।
নোয়াখালীতে বীর নিবাসের কাজে দুর্নীতি, ঘর বুঝে না পেয়ে হতাশা
সংসারে আমিরুলের দুই ছেলে এক মেয়ে আছে। ছেলেরা বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন। মেয়েকে দিয়েছেন বিয়ে। এখনও তাকে এই বয়সে এসে জীবিকার তাগিদে শান দেওয়ার কাজ করতে হচ্ছে।
আমিরুল আরও বলেন, আমি একজন ভূমিহীন মানুষ। এই বয়সে এসে শান দেয়ার কাজ করতে ইচ্ছে করে না। অন্য কোন কাজও জানা নেই। মরার আগ পর্যন্ত শান দেওয়ার কাজ করে বাঁচতে হবে। সারাদিন কাজ করে বাড়িতে ফিরি। আবার সকাল হলেই বেরিয়ে পড়ি কাজে। এভাবেই বাকিটা জীবন কাজের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত রেখে চলে যেতে চাই।
কাকিনার চাপারতলের দর্জি মাস্টার দ্বীনবন্ধু রায় বলেন, আমি এখানে ১০-১২ বছর ধরে টেইলার্সে কাজ করছি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আমার দোকানে এসে কাচি শান দিয়ে যান। কাচি ধার করে (শান দিয়ে) নিয়ে ২০-৩০ টাকা দেই। তিনি যদি এভাবে বের না হতেন তাহলে আমাকে বাজারে এগিয়ে কাচি ধার করে নিতে হত। এতে সময় বেশি লাগতো, টাকাও বেশি নিত।
দলগ্রামের বাসিন্দা মাঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকার অনেক পরিবারের দা-বঁটি মেশিনের মাধ্যমে শান দেওয়া হয়। দা-বটি বাজারে নিতে ঝামেলা। তাই শান দেওয়া লোক বাসার সামনে আসলে তাদের কাছ থেকে দা-বঁটি শান দেই। এতে একটু ঝামেলা কম হয়। শান ওয়ালারা বঁটি শান দিতে নেন ৫০ টাকা, ছুরি ২০ টাকা, ছাপাতি ৮০ টাকা। আমি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি তিনি এই পেশায় নিয়োজিত।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এনডি