দ্বিগুণ মূল্যে কমলাপুর মেট্রোরেলের কাজ পেল ভারতীয় কোম্পানি
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা শহরে মেট্রোরেল নির্মাণের খরচ ভারতের পাটনা, রিয়াদ বা দুবাইয়ের তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ বেশি—একই ধরনের প্রকল্পে।
ভারতের পাটনায় প্রতি কিলোমিটারের খরচ মাত্র ৪০.৭৭ মিলিয়ন ডলার, রিয়াদে ১৬৬ মিলিয়ন ডলার, দুবাইয়ে ১৮৮ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু ঢাকায় এই খরচ দাঁড়িয়েছে ২২৬.৭৪ থেকে ২৫৩.৬৩ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) জানায়, এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের মেট্রোরেল প্রকল্পের খরচই সর্বোচ্চ। রাষ্ট্রায়ত্ত এই সংস্থা রাজধানীর একমাত্র মেট্রোরেল পরিচালনা করছে এবং ভবিষ্যতে আরও কয়েকটি রুটে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।
ডিএমটিসিএল সম্প্রতি জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)-র কাছে মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় পর্যালোচনার অনুরোধ করেছে। ২০২৫ সালের আগস্টে জাপান সফরে গিয়ে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী আনুষ্ঠানিকভাবে জাইকাকে বাংলাদেশের মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় কাঠামো পুনর্মূল্যায়নের প্রস্তাব দেন।
ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা ভবিষ্যতের জন্য প্রতি কিলোমিটারের খরচমান নির্ধারণ করতে সামগ্রিক প্রকল্প ব্যয় পুনর্বিবেচনা করতে চাচ্ছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান টিবিএসকে বলেন, বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মেট্রোরেল নির্মাণ ব্যয় নিয়ে ডিএমটিসিএল কাজ করছে। আগের প্রশাসনের সময় এমন কোনো পর্যালোচনা করা হয়নি। আমরা জাইকাকে স্পষ্ট জানিয়েছি—বাংলাদেশের মেট্রোরেল প্রকল্পগুলোর খরচ হতে হবে টেকসই; যাতে যাত্রী ভাড়ার আয়ে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হয়।
ডিএমটিসিএল জানায়, এমআরটি লাইন-১ (বিমানবন্দর–কমলাপুর) ও লাইন-৫ (উত্তর রুট: গাবতলী–দাশেরকান্দি) প্রকল্পের কয়েকটি টেন্ডারে দরদাতারা প্রাথমিক অনুমানের তুলনায় অনেক বেশি দর দিয়েছে। ফলে কিছু প্যাকেজের টেন্ডার পুনরায় দিতে হয়েছে।
জাইকার অর্থায়নে প্রকল্পগুলো উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়ার অধীনে হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবে জাপানি কোম্পানিগুলোই বেশিরভাগ কাজ পাচ্ছে। এতে প্রতিযোগিতা সীমিত হয়ে প্রকল্পের খরচ বাড়ছে। ডিএমটিসিএল জানায়, তারা জানুয়ারির মধ্যে একটি অভিন্ন দরপত্র প্রক্রিয়ার মানদণ্ড চূড়ান্ত করার লক্ষ্য নিয়েছে। ভবিষ্যতে সব মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য এই মানদণ্ড প্রয়োগ করা হবে।
জাইকার অর্থায়নে দেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্প—উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১.২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন-৬—প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশ ইতিমধ্যেই চালু, বাকি ১.১৬ কিলোমিটার মতিঝিল–কমলাপুর অংশ চূড়ান্ত পর্যায়ে।
পুরো প্রকল্পের ব্যয় ৩৩,৪৭২ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ১,৫৭৪ কোটি টাকা। তবে নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ হওয়ায় ব্যয় পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ নেই।
জাইকার আরও দুটি প্রকল্প—পুরোপুরি ভূগর্ভস্থ এমআরটি লাইন-১ (প্রাক্কলিত ব্যয় ৫৩,৯৭৭ কোটি টাকা) এবং লাইন-৫ উত্তর রুট (প্রাক্কলিত ব্যয় ৪১,২৩৮ কোটি টাকা)—এখন দরপত্র পর্যায়ে রয়েছে।
আরও পড়ুন: রাজধানীতে গ্যাসের গন্ধ, আতঙ্কিত নগরবাসী
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে মেট্রোরেল নির্মাণ ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। ভারতের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। ভারতের উদাহরণ ধরুন—ব্যাঙ্গালুরুতে এখন অনেক উপকরণ স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায়, কিছু লোকাল এক্সপার্টও আছে, আমাদের দেশে নেই। তবে ব্যয় একদম দ্বিগুণ হওয়া যায় না। কিন্তু ব্যয় যে অনেক বেশি তা প্রমাণিত।
তিনি আরও বলেন, ভূগর্ভস্থ অংশের নির্মাণ ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, এমআরটি লাইন-৫ দক্ষিণ রুটে ১৩.১ কিলোমিটার টানেল এবং ৪.১ কিলোমিটার এলিভেটেড রেলপথ রয়েছে।
২০১৯ সালে এমআরটি লাইন-১-এর মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৬.৩৯ বিলিয়ন ডলার, যা এখন বেড়ে ৮ বিলিয়ন হয়েছে। ভারতের পাটনা, পুনে ও ইন্দোরে জাইকা অর্থে নির্মিত মেট্রো প্রকল্প শেষ হয়েছে প্রাক্কলনের তুলনায় ১৪–২৪ শতাংশ কম ব্যয়ে। দিল্লি মেট্রোর গোল্ডেন লাইন টানেল প্রতি কিলোমিটারে মাত্র ২৯.২৯ মিলিয়ন ডলারে নির্মাণ হয়েছে।
ফারুক আহমেদ সতর্ক করে বলেন, এই ব্যয়বৃদ্ধি যাত্রীভাড়া অস্থিতিশীল করতে পারে। উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে ভাড়া ১০০ টাকা। এমআরটি-১ হলে একই দূরত্বে ৩০০ টাকায় পৌঁছাতে পারে। প্রথমবার আমরা সরাসরি জাইকার সঙ্গে খরচ অপ্টিমাইজেশন নিয়ে আলোচনা করেছি। আশা করছি এ বছরের শেষে ফলাফল জানব।
ডিএমটিসিএল জানিয়েছে, সব মেট্রোরেল প্রকল্প ঋণনির্ভর। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঋণ পরিশোধের চাপ কমাতে তারা বিদেশি ইক্যুইটি বিনিয়োগ ও বেসরকারি অংশগ্রহণ আকর্ষণের পরিকল্পনা করছে।
প্রধান কৌশল দুইটি:
- অর্থায়ন কাঠামো পুনর্বিন্যাস।
- নকশা ও নির্মাণে অপ্টিমাইজেশন। উদাহরণস্বরূপ, ছয়টি ডিপোর পরিবর্তে চারটি রাখলে কয়েকশ’ কোটি টাকা বাঁচানো সম্ভব। কম খরচের টানেল কাঠামো ও সমন্বিত ভায়াডাক্ট ডিজাইনও যাচাই করা হচ্ছে।
ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে শেয়ার্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা যৌথ অবকাঠামো ব্যবহার করা হচ্ছে, যেমন একসঙ্গে এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেল নির্মাণে কমন পিলার। স্থানীয় উপকরণ ও কর্মসংস্থান বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর নির্ভরতা কমানো এবং স্থানীয় প্রতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিও লক্ষ্য।
মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেলের বিদ্যুৎ ও যান্ত্রিক ব্যবস্থার কাজ পেয়েছে ভারতের লারসন অ্যান্ড টুব্রু।
২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) অনুযায়ী, খরচ ছিল ২৭৪ কোটি টাকা। তবে চুক্তি হয়েছে ৪৬৫ কোটি টাকায়—প্রাথমিক বরাদ্দের প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি।
সরকার ও ডিএমটিসিএল দাবি করেছেন, দীর্ঘ আলোচনার পর ব্যয় কমানো সম্ভব হয়েছে। প্রাথমিক দরপত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা দাবি করেছিল। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং জাইকার সঙ্গে চুক্তিগত বাধ্যবাধকতার কারণে চূড়ান্তভাবে ৪৬৫ কোটি টাকায় কাজ সম্পন্ন হচ্ছে।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যা চেয়েছে তার থেকে ৩০–৪০ শতাংশ কম মূল্যে কাজ করাতে সক্ষম হয়েছি।
এই চুক্তির আওতায় বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা, স্টেশনের লিফট ও এসকেলেটর, ট্রেনের দরজার সঙ্গে মিলিয়ে দরজা খোলার গেট, মনিটর, সিসি ক্যামেরা, সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থা স্থাপন করা হবে।
উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণে খরচ হয়েছিল ২১,৯৮৫ কোটি টাকা। কিন্তু মাত্র ১.৬ কিলোমিটার মতিঝিল–কমলাপুর অংশের খরচ ধরা হয়েছে ১১,৪৮৭ কোটি টাকা।
ডিএমটিসিএল আশা করছে, নতুন স্টেশন চালু হলে বছরে অন্তত আরও ১২৬ কোটি টাকা রাজস্ব বাড়বে।
বর্তমানে পিলারের কাজ প্রায় শেষ, ভায়াডাক্ট স্থাপন ধীরে ধীরে চলছে এবং নির্মাণ অগ্রগতি প্রায় ৫৯ শতাংশের কাছাকাছি।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি








