নওগাঁয় নবমী উৎসবে লাখো ভক্তের ঢল
নওগাঁ: রামের জন্মোৎসবকে ঘিরে প্রায় তিনশ বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধ স্থান নওগাঁর মান্দা উপজেলার ঠাকুরমান্দায় শ্রী-শ্রী রঘুনাথ জিও মন্দির প্রাঙ্গণে সনাতন ধর্মালম্বী, পূণ্যার্থী, ভক্তসহ সকল ধর্ম-বর্ণের লাখো মানুষের ঢল নেমেছে।
নারী-পুরুষ ভক্তের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে মন্দিরের চারপাশ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তসহ ভারত, নেপাল থেকেও এসেছেন পূণ্যার্থীরা।
রাম-নবমী উপলক্ষে চৈত্র মাসে রামের জন্ম তৃতীয়া শুক্লা তিথিতে শনিবার মন্দিরে বিশেষ পূজার্চনার আয়োজন করা হয়।
ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে শুরু হয় এ পূজার্চনা। নদিনব্যাপী এ পূজা চলবে রোববার পর্যন্ত। সকালেই ভক্ত ও পূণ্যার্থীরা গঙ্গাস্নান করে কেউ মাথায়, কেউ কাঁধে, কেউ হাতে করে আবার কেউ দুর্লভ পদ্মপাতা মাথায় দিয়ে তার ওপর মাটির পাতিল বোঝাই ভোগের মিষ্টান্ন মাথায় নিয়ে দীর্ঘ লাইন ধরে প্রভূর চরণে নিবেদন করছেন।
পূণ্যার্থীরা এ সময় রামের জয়গান উচ্চারণ করে নিজেদের মনস্কামনা পূরণের জন্য মন্দিরের চারপাশে সাত পাক দিয়ে আরাধনা করছেন।
মন্দিরের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ভক্ত-পূণ্যার্থীরা পরিবার পরিজন নিয়ে খোলা মাঠে, গাছের নিচে, কারও বাড়ির বারান্দায় ঠাঁই নিয়েছে। তারা এই নয়দিন ধরে সেখানে অবস্থান করবেন বলে জানিয়েছেন ভক্তরা।
ভক্তদের ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে প্রতিদিন রাতে পদাবলী কীর্তনেরও আসর বসানো হয় বলে জানিয়েছেন মন্দির কর্তৃপক্ষ।
মন্দিরটি ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রাম নবমীর উৎসব, এ অঞ্চলের মানুষের সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। এ উপলক্ষে মন্দির প্রাঙ্গণসহ আশপাশের এলাকায় বসেছে মেলা। মেলায় আসবাবপত্র, চুরি-ফিতা, মিঠাই-মিষ্টান্নসহ বিভিন্ন ধরনের পসরা নিয়ে বসেছে দোকানীরা।
রাজশাহী গোদাগাড়ী এলাকার নিমাই চন্দ্র সাহা জানান, “তিনি প্রতি বছর এই উৎসবে যোগ দেন। থাকেন পুরো এক সপ্তাহ। এ সময় মন্দিরেই নানা পূজা-অর্চনায় লিপ্ত থাকেন তিনি।
একই রকম কথা বললেন পাবনার চাটমোহর এলাকার ৬০ বছরের বৃদ্ধা কমলা রাণী বালা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ এলাকার আদিবাসী অনিল মারান্ডী তিনি পরিবার ৬ সদস্য নিয়ে এই মন্দিরে এসেছেন এই প্রথম। তিনি সকালেই পূজা-অর্চনার কাজ শেষ করেছেন। তিনি বলেন,“অনেকের কাছেই শুনেছি। মন্দিরে এসে প্রার্থনা করলে যা চাওয়া যায়, তাই পাওয়া যায়। তাই আমিও পরিবারসহ কিছু মনস্কামনা পূরণের জন্য মন্দিরে প্রার্থনা করেছি।”
একই কথা বললেন পাশের নিয়ামতপুর উপজেলার গাংগুরিয়া গ্রামের গৃহবধূ অনিতা রাণী। এভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের নানা পেশার মানুষের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণ মুখর হয়ে উঠেছে।
জনপদটি নওগাঁর মান্দা উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক উল্লেখ করে মন্দির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি চন্দন কুমার মৈত্র বলেন, “মন্দিরটি ১৭৮০ সালে নাটোরের রাণী ভবানী নির্মাণ করেন।”
তিনি কিংবদন্তির কথা উল্লেখ করে আরও বলেন, “মান্দার বিল খননের সময় পাওয়া গিয়েছিল রাম, লক্ষণ, সীতা ও রামভক্ত হনুমানের বিগ্রহ। প্রাপ্ত বিগ্রহ স্থাপন করে পূজার্চনা শুরু করা হয়েছিল।”
কথিত আছে, জনপদটিতে বাস করতেন দরিদ্র এক অন্ধ ব্রাহ্মণ। তিনি রামভক্ত ছিলেন। তিনি বিলে স্নান করতে নামলে কাঠের বিগ্রহগুলো ভাসতে ভাসতে তার শরীরে স্পর্শ করে। তিনি প্রণাম করে মূর্তিগুলো মাথায় ও কোলে নিয়ে বাড়ি ফিরেন। জনপদের বাড়িতে তা স্থাপন করে তিনিই প্রথম পুজা করেন। প্রতিদিন তিনবার করে পুজা করতেন তিনি। পূজাকালে একদিন হঠাৎ করেই দৃষ্টি ফিরে পান। তার সাংসারে সচ্ছলতাও ফিরে আসে।
তখন থেকেই এই রঘুনাথ বিগ্রহের অলৌকিকত্বের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বাড়তে থাকে ভক্তদের ভিড়।
নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে মান্দা উপজেলার এই ঠাকুর মান্দা গ্রামের অবস্থান। একসময় এই মন্দিরের চারধারে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল শুধু জলাশয়।
মন্দিরের পুবপাশ দিয়ে বয়ে গেছে শিব নদী। এ নদীতে ভক্ত দর্শনার্থীরা গঙ্গাস্নান করে ভেজা কাপড়ে পাশের বিল থেকে পদ্মের পাতা তুলে মাথায় দিয়ে মন্দিরে যেতেন ঠাকুর দর্শনে। এখনো কিছুটা হলেও ভক্তরা সেই রীতি-নীতি মেনে চলার চেষ্টা করেন। নদী এবং জলাশয়ে পানি না থাকলেও ভক্তরা মন্দির সংলগ্ন পুকুরে স্নান করে ভেজা কাপড়ে কেউ কেউ আবার দুর্লভ পদ্মপাতা সংগ্রহ করে তা মাথায় দিয়ে তার ওপর মাটির পাতিল বোঝাই ভোগের মিষ্টান্ন মাথায় নিয়ে দীর্ঘ লাইন ধরে প্রভূর চরণে নিবেদন করে থাকেন।
নিউজবাংলাদেশ.কম/কেজেএইচ
নিউজবাংলাদেশ.কম








