মাইলস্টোনের ৩ শিক্ষিকার সাহসিকতা চিরস্মরণীয়: প্রধান উপদেষ্টা
ছবি: সংগৃহীত
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত তিন শিক্ষক, মাহেরীন চৌধুরী, মাসুকা বেগম এবং মাহফুজা খানমকে ‘মানবতা ও সাহসিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, এই তিন শিক্ষক তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে জাতির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নিহত তিন শিক্ষকের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এক আবেগঘন সাক্ষাতে তিনি এই মন্তব্য করেন।
এই তিন শিক্ষকের আত্মত্যাগ মানুষের মনে যে প্রশ্ন জাগিয়েছে, তা হলো— আমি যদি সেই অবস্থানে থাকতাম, আমি কি জীবনের পরোয়া না করে এভাবে ছোট শিশুদের প্রাণ বাঁচাতে আত্মবিসর্জন দিতাম?
সাক্ষাৎকালে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
তিনি বলেন, বেশ কিছুদিন পার হলেও এই স্মৃতি এখনও সবার মধ্যে দগদগে হয়ে আছে। এই শোক আপনাদের একার নয়; জাতি হিসেবে আমরাও এই শোককে ধারণ করি।
তিনি নিহত শিক্ষকদের পরিবারের কাছে তাদের স্মৃতিকথা শুনতে চাইলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
শিক্ষক মাহেরীন চৌধুরীর স্বামী মনসুর হেলাল আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, দুর্ঘটনার পর স্ত্রীকে যখন হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল, তখন ফোনে তার সঙ্গে শেষ কথা হয়।
আরও পড়ুন: প্রকৃতি-প্রতিবেশ নষ্ট হলে মাছ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে: প্রধান উপদেষ্টা
তিনি জানান, বার্ন ইনস্টিটিউটে তিনি দেখতে পান, তার স্ত্রী প্রায় সম্পূর্ণ দগ্ধ অবস্থায় আছেন। সেখানে চিকিৎসাধীন কয়েকজন শিশু তাকে জানায়, ‘মিসই আমাদের টেনে টেনে বের করে আনলো! মিস তো সুস্থ ছিল! এমন হলো কেন!’ তিনি যখন তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন, কেন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিশুদের বাঁচাতে গেলেন, তখন মাহেরীন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি?’
মনসুর হেলাল আরও জানান, মাহেরীন চৌধুরী সবার জন্যই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন এবং দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ তার জন্য প্রার্থনা করেছে।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ২৪ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ১৪ আগস্ট মারা যান শিক্ষক মাহফুজা খাতুন। তার মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘আমার মা অনেকখানি সুস্থ হয়ে উঠেছিল। আমি ভেবেছিলাম, মা’কে নিয়ে বাড়ি ফিরব। কিন্তু এখন আমি এতিম হয়ে গেলাম।’
তিনি আরও বলেন, মা ছাড়া তিনি নিজের বাসায় ফিরতে পারছেন না।
শিক্ষক মাসুকা বেগমের ভগ্নিপতি খলিলুর রহমান জানান, মাসুকা বেগমের বাবা ও বোন অসুস্থ এবং তাদের চিকিৎসায় তিনি সবসময় সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন। তিনি নিয়মিত বাবাকে হাতখরচ পাঠাতেন এবং তার ছেলে-মেয়েদের নিজের সন্তানের মতো দেখতেন। তার জীবন ছিল কেবল পরিবার আর স্কুলকে ঘিরে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তাদের কথা শুনতে কষ্ট লাগে, কিন্তু একই সঙ্গে গর্ববোধ হয় যে আমাদের দেশে এমন নাগরিক আছেন যারা অন্যের জীবন বাঁচাতে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, এই শিক্ষকরা তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে মানবতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা আমাদের দেশের ক্ষুদ্র মানবদের বড় করে দিয়েছে।
প্রফেসর ইউনূস বলেন, এই শিক্ষকরা আমাদের গর্ব, আমাদের আদর্শ। তাদের স্মৃতি আমাদের ধরে রাখতে হবে। এজন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, আমরা তা করব। তিনি নিহত শিক্ষকদের স্মরণে পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার করেন।
এসময় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ, সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং প্রধান উপদেষ্টার এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ।
এই সাক্ষাতে নিহত শিক্ষক মাহেরীন চৌধুরীর পরিবারের পক্ষে তার স্বামী মনসুর হেলাল, দুই ছেলে আদিল রশিদ ও আয়ান রশিদ, বোন মেহেতাজ চৌধুরী এবং ভাই মুনাফ মজিব চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষক মাসুকা বেগমের পরিবারের পক্ষে ছিলেন তার বোন পাপড়ি রহমান ও ভগ্নিপতি খলিলুর রহমান। শিক্ষক মাহফুজা খাতুনের পরিবারের পক্ষে ছিলেন তার মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা এবং বোন মুরশিদা খাতুন।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি








