গুগল-ফেসবুকের ‘পৌরাণিক লড়াইয়ে’ ড্রোন
গুগল, আমাজনের সঙ্গে এবার আকাশ দখলের দৌড়ে মাটি থেকে ১২ মাইল উচ্চতায় ড্রোন নিয়ে যুদ্ধে সামিল হচ্ছে ফেসবুক। আকাশের দেবতা জুপিটারের বজ্রবাহী ইগলের নামে এক ড্রোন প্রকল্প হাতে নেওয়ার কথা জানিয়েছে সামাজিক যোগাযোগের সেবাদাতা এই প্রতিষ্ঠানটি।
`অ্যাকুইলা` নামের এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষের কাছে ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। চলতি বছরেই এই ড্রোনের পরীক্ষা চালানো হবে। তবে, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এই ড্রোন চালু করতে আরও কয়েক বছর লেগে যাবে।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেসবুকের ড্রোনটি দেখতে ইংরেজি ‘ভি’ আকৃতির মতো। ছোট একটি গাড়ির ওজনের সমান এই যানটির পাখার দৈর্ঘ্য বোয়িং ৭৬৭-এর সমান। সৌরশক্তিচালিত এই যানটি আকাশে ওড়ার সময় ইন্টারনেট বিম ছাড়বে। এর সাহায্যেই ইন্টারনেট সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে যাবে। একই সঙ্গে এক হাজারের বেশি এই চালকবিহীন বিমান বা ড্রোন আকাশে ছেড়ে একটি নেটওয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে ফেসবুকের।
সম্প্রতি সান ফ্রান্সিসকোতে এক সম্মেলনে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেন। মানুষের মধ্যে প্রভাব বাড়াতে ভবিষ্যতে ইন্টারনেট ড্রোন, ভারচুয়াল রিয়েলিটিযুক্ত চশমা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্র তৈরির তথ্যও জানান তিনি।
ফেসবুক কীভাবে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেসেঞ্জারের কোড খুলে দিচ্ছে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে মোবাইল কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রে এসব পদক্ষেপ কতখানি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে সে বিষয়ে কথা বলেন জাকারবার্গ।
ফেসবুকের মোবাইল মেসেজিং অ্যাপ ৫০ টিরও বেশি অ্যাপ সমর্থন করবে জানিয়ে তিনি ডেভেলপারদের উদ্দেশ্যে বলেন, এতদিন আমরা কেবল মেসেঞ্জারের সব ফিচার নিজেরাই তৈরি করে মেসেঞ্জারকে উন্নত করতে কাজ করেছি। এখন আমরা এই প্ল্যাটফর্ম উন্মুক্ত করার মাধ্যমে অ্যাপ নির্মাতাদের সৃজনশীলতাকে তুলে আনতে চাই।
গত বছর অধিগ্রহণকৃত অ্যাসেন্টার কর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় ফেসবুকের ড্রোন টিম। ‘অ্যাকুইলা’ নামের এই প্রকল্পে এই টিমটি সৌরশক্তিচালিত ড্রোন তৈরি করবে। ফেসবুকের এই ড্রোন একটানা তিন মাস আকাশ থেকে (৬০ হাজার থেকে ৯০ হাজার ফুট) দ্রুত গতির লেজার বিম নিক্ষেপ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধা দিতে পারবে।
ফেসবুক কানেকটিভিটি ল্যাবের প্রধান ইয়েল ম্যাগুয়ার বলেন ‘আমরা বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবা দিতে চাই। আমরা কী এমন একটি জায়গায় যেতে পারব যেখানে বিশ্বের সব মানুষ একই সময়ে একই বার্তা পাবে? আমি সেই দিনটির অপেক্ষায় আছি। সেই দিনটি পেতে হয়তো অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে।’
প্রসঙ্গত, মাটি থেকে ১২ মাইল উচ্চতায় বাণিজ্যিক বিমানগুলোও যেখানে ডানা মেলে না, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের সেই অঞ্চলটিতে নিজেদের কেতন ওড়াতে গুগল ও ফেসবুক দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছিল। এতে সরাসরি কোনো লড়াই না দেখা গেলেও বাণিজ্যিক বিষয়গুলোতে দ্বন্দ্ব বেশ প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। গুগল গত ১৫ এপ্রিল সৌরশক্তিচালিত ড্রোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টাইটান অ্যারোস্পেসকে কিনে নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। অ্যারোস্পেসকে কিনতে গত মার্চ মাসেই আগ্রহ দেখিয়েছিলেন ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ। তবে টাইটান কিনতে না পারলেও জাকারবার্গ কিনে নেন ড্রোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাসেন্টাকে। এই অ্যাসেন্টার কর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলা ফেসবুকের টিমই `অ্যাকুইলা` নামের ড্রোন প্রকল্পের উদ্ভাবক।
গুগল ও ফেসবুক উভয় প্রতিষ্ঠানের দাবি, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে দিতেই তাদের এই বিনিয়োগ। তবে এই ধরনের উচ্চাভিলাসী প্রকল্প ইতিমধ্যে সমালোচনার মুখে পড়েছে। এর আগে ফেসবুকের দাতব্য সংগঠন ইন্টারনেট অর্গানাইজেশনে ব্যবসায়িক স্বার্থ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। অপরদিকে গুগলের বেলুন দিয়ে ইন্টারনেট প্রকল্প ‘লুন’ প্রকল্পের সমালোচনা করে বিল গেটস বলেছিলেন, ‘যেখানে অসংখ্য শিশু ডায়রিয়ায় মারা যাচ্ছে, তখন বেলুনের দিকে তাকিয়ে কী হবে, তা আমি ভেবে পাই না।’
প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা জানান, গুগল ও ফেসবুকের ড্রোন প্রকল্পে বিশেষ এই অর্থলগ্নি করার পেছনে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য পরিষ্কার হলেও এ থেকে তারা কীভাবে লাভ করবেন তা এখনও বোধগম্য নয়।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এড লাজোস্কা বলেন, ‘ফেসবুক, গুগল, আমাজন সম্পূর্ণ নতুন জিনিস নিয়ে কাজ করছে যা মানুষের জীবন পাল্টে দিতে পারে। হিউলেট-প্যাকার্ড (এইচপি) বা আইবিএমের মতো প্রতিষ্ঠানও আছে কিন্তু তারা এত বড় প্রকল্প নিয়ে ভাবছে না।’
সমালোচনা, সংশয় আর বাণিজ্যিক ও সামাজিক লাভ-লোকসান এবং প্রভাব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক যতই চলুক ইন্টারনেট জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর এসব ড্রোন প্রকল্প থেকে পাওয়া সুবিধার কিছু অংশ বৈজ্ঞানিক ও মানবিক কাজে ব্যবহৃত হবে নিঃসন্দেহে। অনেক পৌরাণিক যুদ্ধ যেমন আকাশের ময়দানে হলেও তার কাহিনীর বিস্তার যেমন পৃথিবী ধারণ করে আছে, তেমনি গুগল ও ফেসবুকের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে ড্রোনগুলোও লাভ-লোকসানের গল্পের মধ্যেই শেষ পর্যন্ত কল্যাণের সাপেক্ষেই থাকবে, এমনাই আশা করা যায়।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এসজে
নিউজবাংলাদেশ.কম








