News Bangladesh

পরিতোষ লিমন, সাংবাদিক || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১১:৩৯, ৩০ মে ২০২৫
আপডেট: ১৫:৫৮, ১ জুন ২০২৫

পাহাড়ি খাবার: প্রাকৃতিক স্বাদে বোনা এক ঐতিহ্য

পাহাড়ি খাবার: প্রাকৃতিক স্বাদে বোনা এক ঐতিহ্য

ছবি: বাহারি পাহাড়ি

বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য আমাদের খাদ্যসংস্কৃতিকে করেছে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এর মধ্যে পাহাড়ি অঞ্চলের খাবার এক অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, যা প্রাকৃতিক উপাদান, স্বল্প মসলা, এবং স্বাস্থ্যকর রান্নার পদ্ধতির মাধ্যমে গঠিত। 

প্রাকৃতিক পরিবেশ, সহজলভ্য উপাদান এবং এই অঞ্চলের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব রন্ধনপ্রণালীর মেলবন্ধনে গড়ে উঠেছে পাহাড়ি খাবারের এক বিশাল ভাণ্ডার তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। যা শুধু স্বাদের জন্য নয়, পুষ্টিগুণের দিক থেকেও অনন্য।

প্রকৃতির সান্নিধ্যে পাহাড়ি খাবার
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর খাবারে সাধারণত তেল ও অতিরিক্ত মসলার ব্যবহার খুব কম। তারা রান্নায় গুরুত্ব দেন খাবারের প্রাকৃতিক স্বাদ ও পুষ্টিগুণকে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শাকসবজি, শুঁটকি, মাংস, মাছ, বুনো গুল্ম, বাঁশ কোড়ল ইত্যাদি উপাদানে তৈরি খাবারগুলো যেমন সহজলভ্য, তেমনি সৃজনশীল এবং স্বাস্থ্যসম্মত।

জনগোষ্ঠীভিত্তিক খাবারের বৈচিত্র্য

  • গারো সম্প্রদায়

গারোদের খাবারে তেল-মসলা প্রায় নেই বললেই চলে। তাদের অনেক খাবারে ব্যবহৃত হয় শুঁটকি ও খাবার সোডা। শূকরের মাংস তাদের উৎসব-পার্বণের প্রধান পদ। ‘ওয়াক ঘুরা’ নামের ঐতিহ্যবাহী খাবারে থাকে শূকরের মাংস, চালের গুঁড়া, আদা, পেঁয়াজ, রসুন ও মরিচ। ‘হিথোপ্পা’ নামে কলাপাতায় মোড়া ছোট মাছের পদটিও বেশ জনপ্রিয়।

  • চাকমা সম্প্রদায়

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পাহাড়ি জনগোষ্ঠী চাকমারা। তারা সাধারণত সেদ্ধ ঝাল-সবজি এবং শুঁটকি দিয়ে তৈরি ‘সিদল’ খায়। ‘পাচন ত্রোণ’ নামের খাবারটি চাকমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী পদ, যা চৈত্রসংক্রান্তিতে বিভিন্ন সবজির মিশ্রণে তৈরি করা হয়।

  • মারমা সম্প্রদায়

মারমাদের খাবার বৈচিত্র্যময় হলেও তেল ও মসলার ব্যবহার খুব কম। ‘হাংরো’ নামে একটি সবজি ও শুঁটকি দিয়ে তৈরি খাবার সাংগ্রাই উৎসবে রান্না করা হয়। এছাড়া ‘বাঁশ কোড়ল’ এবং বিকেলে খাওয়া ‘মুক্তি’ (নুডলসের মতো একটি খাবার) বেশ জনপ্রিয়।

  • মণিপুরি সম্প্রদায়

মণিপুরিদের খাবারে মাংস নিষিদ্ধ হলেও ঐতিহ্যগতভাবে তাদের ‘খার’ নামের একটি পদ রয়েছে, যা আঠালো ভাত, সিদ্ধ সবজি ও ডাল দিয়ে তৈরি হয়। তাদের রান্নায়ও তেল-মসলার ব্যবহার অত্যন্ত কম।

  • সাঁওতাল ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়

সাঁওতালরা ভাত খান স্যুপের মতো করে, সাথে খরগোশ, শূকর, কাঁকড়া প্রভৃতি মাংস। ত্রিপুরাদের জনপ্রিয় নিরামিষ পদ ‘পাজন’ বিভিন্ন শাকসবজি সেদ্ধ করে তৈরি করা হয়, যেখানে তেল-মসলা ব্যবহার হয় না।

আরও পড়ুুন: ১০ মাসে গ্রেপ্তার ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৭৯৮ জন

  • অন্যান্য সম্প্রদায়

মুণ্ডা, রাজবংশী, খাসিয়া, ওরাও, রাখাইন, কোচ, বুনা, চাক, হাজং, তঞ্চঙ্গা, টিপরা প্রভৃতির রান্নায়ও পাওয়া যায় বাঁশ কোড়ল, সিদল, শাকসবজি, ও শুঁটকির চমৎকার ব্যবহার। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর রন্ধনপ্রণালীই আলাদা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ।

প্রতিটি পদে স্থানীয় স্বাদ

  • বাম্বু চিকেন (পার্বত্য চট্টগ্রাম)

মুরগির মাংস, আদা, রসুন, কাঁচা মরিচ ও অন্যান্য মসলা মিশিয়ে বাঁশের কঞ্চির মধ্যে ভরে ধীরে ধীরে আগুনে সেদ্ধ করা হয়। এতে মাংসে বাঁশের এক অনন্য সুবাস যুক্ত হয়।

  • সিধোল মাছ (পার্বত্য চট্টগ্রাম)

চাকমাদের বিশেষ খাবার সিধোল শুঁটকি মাছ দিয়ে তৈরি হয়, যা পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মরিচ দিয়ে রান্না করা হয়। এর ঝোল বা ভর্তা দুটোই সমান জনপ্রিয়।

  • বাঁশকোড়ার তরকারি (পার্বত্য চট্টগ্রাম)

নরম বাঁশের কাণ্ড বা বাঁশকোড়াকে কুচি করে পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ দিয়ে ভাজা হয়। অনেক সময় এতে চিংড়ি বা মাংসও দেওয়া হয়।

  • জুম চালের ভাত ও বাঁশপোড়া মাংস (পার্বত্য চট্টগ্রাম)

জুম ধানের চাল দিয়ে তৈরি হয় সুগন্ধি ভাত। এর সাথে বাঁশের মধ্যে রান্না করা মাংস পরিবেশন করা হয়। মাংসের মধ্যে বাঁশের স্বাদ মিশে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা দেয়।

  • কচু পাতা দিয়ে মাছ (ময়মনসিংহ-শেরপুর)

কচু পাতা ও ছোট মাছ দিয়ে তৈরি এই খাবারটি স্লিপারি টেক্সচারে এবং খুবই পুষ্টিকর।

পাহাড়ি খাবারের বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব
পাহাড়ি খাবারগুলো সাধারণত প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি, তেল-মসলা কম ব্যবহার করা হয়, এবং স্বাস্থ্যসম্মত। এই খাবারগুলো শুধু স্বাদের জন্য নয়, পুষ্টিগুণের জন্যও সমাদৃত। 

স্বাস্থ্য এবং সতর্কতা
পাহাড়ি খাবারে ব্যবহৃত হয় অনেক বুনো শাক, গুল্ম ও মাশরুম, যা কিছু মানুষের জন্য অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। তাছাড়া অতিরিক্ত ঝাল বা অচেনা শুঁটকি থেকেও হজমজনিত সমস্যা হতে পারে। তাই নতুনদের জন্য এসব খাবার খাওয়ার আগে উপাদান সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি। বিশেষ করে যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা অ্যালার্জি রয়েছে, তাদের অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

এক অনন্য খাদ্যভ্রমণ
বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের খাদ্যসংস্কৃতি একটি সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্য, এটি পরিবেশের কাছাকাছি থাকা মানুষের জীবনযাপন ও সংস্কৃতির প্রতিফলন। প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি, সহজপাচ্য, স্বল্প মসলা এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ এই খাবারগুলো স্বাস্থ্যকর রান্নার পদ্ধতির মাধ্যমে গঠিত। এই খাদ্যসংস্কৃতি একদিকে যেমন আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে এবং ভোজনরসিকদের জন্য নতুন স্বাদের অভিজ্ঞতা দেয়, অন্যদিকে আমাদের শিকড়ে ফিরে যাওয়ার, প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার বার্তাও দেয়।

নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়