‘ডিপ স্টেট’-এর কৌশলে হাসিনার পতন: নেপথ্যে ‘দরবেশ’ ও দুই মন্ত্রী
ছবি: সংগৃহীত
অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির এক বছর পর তার সরকারের ভেতরে ঘটে যাওয়া অজানা কাহিনি নিয়ে বিস্তৃত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নর্থইস্ট নিউজ ইনডিয়া।
সাংবাদিক চন্দন নন্দীর এ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়টায় যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত ‘ডিপ স্টেট’ সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে সরকারের ভেতরের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণে নেয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ তিনজন—প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত—২০২৪ সালের প্রথম থেকেই এমন কার্যক্রম চালিয়েছিলেন যা শেষ পর্যন্ত সরকারের স্বার্থের বিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। তাদের ভূমিকার কারণেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনে সরকার ও দল কাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই তিনজনের মধ্যে সালমান এফ রহমান এবং আনিসুল হককে ৫ আগস্টের পর ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়, যদিও মোহাম্মদ এ আরাফাত তার ‘পশ্চিমা যোগাযোগ’ ব্যবহার করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা করা হয়।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি লিখেছে, হাসিনা সরকারের শেষ সপ্তাহে এই তিন ব্যক্তি এমন কিছু কর্মকাণ্ড করেছিলেন যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বার্থের ক্ষতি করেছে।
প্রতিবেদনে সালমান এফ রহমানকে ‘দরবেশ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে, যিনি মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।
একজন সাবেক মন্ত্রীর মতে, ‘দরবেশ’ কার্যত শেখ হাসিনাকে তার ঘনিষ্ঠজনদের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন।
নর্থইস্ট নিউজ জানিয়েছে যে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই মার্কিন ‘ডিপ স্টেট’ বাংলাদেশে ‘ক্ষমতার পট পরিবর্তনের’ পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে। তবে এই পরিকল্পনা ২০২৩ সালের এপ্রিল-মে মাসে আরও গতি পায়, যখন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এবং তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বাংলাদেশে ‘অবাধ ও মুক্ত’ নির্বাচনের ব্যাপারে প্রকাশ্যে আলোচনা শুরু করেন।
২০২২ সালের জুনে ভারতের একটি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে নর্থইস্ট নিউজ দাবি করেছে যে, পিটার হাসের কর্মকাণ্ডও শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ ছিল। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে যখন শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন, তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মার্কিন ‘ডিপ স্টেট’ তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চাইছে। সেই সময় তিনি দলের ঘনিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে তার সরকারের সামনে ছয়টি ‘জটিল সমস্যার’ কথা তুলে ধরেন, যা মার্কিন চাপের ফল ছিল।
আরও পড়ুন: জিয়াউর রহমানের সমাধিতে বিএনপির শ্রদ্ধা
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা কখনো এই তিন ব্যক্তির বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি সন্দেহ করেননি, কিন্তু এখন তিনি তাদের ভূমিকা সম্পর্কে অবহিত। ‘দরবেশ’ হিসেবে পরিচিত সালমান এফ রহমান শেখ হাসিনার ওপর কঠোর নজর রাখতেন এবং তার চলাফেরা ও সাক্ষাৎ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতেন।
২০২৩ সালের এপ্রিল-মে মাসে শেখ হাসিনার জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় একটি রহস্যজনক ঘটনা ঘটে। ওয়াশিংটনে শেখ হাসিনা যেখানে রিটজ কার্লটন হোটেলে ছিলেন, সেখানে সালমান এফ রহমান সেন্ট রেজিস হোটেলে উঠেছিলেন।
নর্থইস্ট নিউজ দাবি করেছে, সালমান সেখানে একটি গোপন বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন, যেখানে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে নতুন একটি মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম চালু করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দেশে ফিরে সালমান আরাফাতের মাধ্যমে সেই পরিকল্পনা বাতিল করে দেন।
নর্থইস্ট নিউজের মতে, সালমান এফ রহমান নিয়মিতভাবে অন্তত ছয়জন মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, যাদের মধ্যে উইলিয়াম বি মাইলাম, আফরিন আক্তার এবং মার্শা বার্নিকাটও ছিলেন।
২০২৪ সালের ৩ আগস্ট, যখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তুঙ্গে, তখন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতের একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে দেওয়া মন্তব্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
তিনি বলেছিলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলন মোকাবিলার মতো যথেষ্ট বুলেট সরকারের হাতে আছে’, যা জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়িয়েছিল।
প্রতিবেদনে এই মন্তব্যকে ‘সচেতনভাবে’ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা সরকারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরিতে সহায়তা করেছিল।
নর্থইস্ট নিউজ আরও জানিয়েছে যে, ৩০ জুলাই যখন আন্দোলন তীব্র হচ্ছিল, তখন সালমান এফ রহমান শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানাকে যুক্তরাজ্য থেকে ঢাকায় আসার অনুরোধ করেন। রেহানাকে দিয়ে শেখ হাসিনাকে বোঝানো হয়েছিল যে, বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা এড়াতে আওয়ামী লীগের পূর্বনির্ধারিত সমাবেশ বাতিল করতে হবে। দলের নেতারা সমাবেশ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে থাকলেও শেখ রেহানার নির্দেশে শেষ পর্যন্ত সেই কর্মসূচি বাতিল করা হয়। এর ফলে ইসলামী ছাত্রশিবির, জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির কর্মীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের প্রতিরোধ গড়ার সুযোগ শেষ হয়ে যায়।
বর্তমানে কলকাতায় অবস্থানরত আওয়ামী লীগ নেতারা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তারা অভিযোগ করেছেন যে, ক্ষমতায় থাকাকালীন দলীয় নেতারা কোনো সমালোচনা বা মূল্যায়নের সুযোগ পাননি, যার ফলে দল দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়েছে যে, শেখ হাসিনার ‘বিচ্ছিন্নতার’ একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল ২০২৩ সালের ৮ থেকে ১০ জুলাই তার চীন সফর। নির্ধারিত সময়ের একদিন আগে দেশে ফেরা ইঙ্গিত দেয় যে, তার চীন সফর সফল হয়নি। ওই সময়ে ভারতও শেখ হাসিনার প্রতি নাখোশ ছিল বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, কারণ তারা ওই সফরকে কৌশলগতভাবে ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ হিসেবে গণ্য করেছিল।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি








