News Bangladesh

|| নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৭:৪৬, ২৯ মার্চ ২০১৫
আপডেট: ২০:৪০, ১৭ জানুয়ারি ২০২০

কুকুরে কামড়ানো কি মানুষের শোভা পায়?

কুকুরে কামড়ানো কি মানুষের শোভা পায়?

‘বাংলার কথা’ নামে ভারতের একটি অনলাইন পত্রিকা ২৬.৩.২০১৫ তারিখে “ভারতের পরাজয়ে উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশ, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা” শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে। এতে ভুলভাল বাংলায় লিখেছে- “গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে শহরের চৌরাস্তা থেকে শুরু করে শপিং মল ও রাস্তাঘাট সবেতেই যেন এক উত্সবের পরিবেশ, ভারত হেরেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি তে বিজয় সমাবেশ ও মিছিল বার হয়, ঢাকার পথঘাট ছেয়ে যায় আনন্দে মাতোয়ারা বাংলাদেশীদের উচ্ছাসে। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক সংগঠন এই সকল সমাবেশের আয়োজন করে। কি নাস্তিক কি আস্তিক, কি চরমপন্থী, কি মুক্তমনা- আজ ভারতের পরাজয়ে সবাই উচ্ছসিত। এই উচ্ছাস বাংলাদেশের জয়ের জন্য কম, ভারতের পরাজয় ও অপমানের জন্য বেশি।”

এর আগে টাইমস অব ইন্ডিয়ার সহযোগী `এই সময়` নামে একটি পত্রিকা ২৭ মার্চ দুপুরে তার অনলাইন সংস্করণে `ভারতের হারে আনন্দিত বাংলাদেশ, ঢাকায় বিজয় মিছিল` শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। সংবাদের সাথে আইসিসি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ভারতের শোচনীয় পরাজয়ে বাংলাদেশের বিজয় মিছিলের একটি ছবিও ছাপে।

বাংলাদেশকে উদ্দেশ্য করে পত্রিকাটির খবর বলেছে, “এত রাগ? কিসের রাগ বা কেন এই অসঙ্গত রাগ তা নিয়ে দু`ছত্র বলতে বললে অনেকেই পারবেন না। আর বলতে চাইবেনও না হয়তো, কারণ যুক্তিহীন রাগ কোনও বাস্তবতার ধার ধারে না। ধারছেও না। বাংলাদেশে। ভারতের হেরে যাওয়ায় উল্লাসে মাতলেন সে দেশের নাগরিক।”


সংবাদে আরও লেখা হয়েছে, “বৃহস্পতিবার সিডনিতে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের পরাজয়ে উল্লাসিত হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আনন্দের আবহে মিছিল করেছেন বাংলাদেশিরা। অস্ট্রেলিয়ার জয়ে নয়, মূলত ভারতের হারেই তারা আহ্লাদে আটখানা হয়েছেন। কোয়ার্টার ফাইনালে বাজে আম্পায়ারিংয়ের অজুহাতে হার স্বীকার করতে অসুবিধা হয়েছে তাদের। সেটা ব্যবহারেও বেশ প্রকট। বিকেলে ভারতের শেষ উইকেট পড়ার পরপরই ঢাকার রাস্তায় `আনন্দ মিছিল` করে জমায়েত করেন ভারত বিদ্বেষী ক্রিকেটপ্রেমীরা ফলে অস্ট্রেলিয়ার জয়ে যারপরনাই উল্লসিত বাংলাদেশিরা। বৃহস্পতিবার সিডনিতে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের পরাজয়ে উল্লাসিত হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আনন্দের আবহে মিছিল করেছেন বাংলাদেশিরা। অস্ট্রেলিয়ার জয়ে নয়, মূলত ভারতের হারেই তাঁরা আহ্লাদে আটখানা হয়েছেন।”


ভারতের পত্রিকাটির এই নিচু মানসিকতাসম্পন্ন সংবাদের প্রতিকূলে লিখতে শুরু করেছিলাম তখনই। পরিচিত অনেকে উৎসাহিত করেছেন এবং কেউ কেউ পত্রিকাটির ভব্যতা ও রুচিবোধ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ বলেছেন, এর পেছনে অন্য কোনো নিভৃত ‘ডালমে কুচ কালা’ লুকায়িত আছে কি না তা খুঁজে দেথতে। কেউ সন্দেহ পোষণ করে বলেছেন- কোনো সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ভারতের সাথে বাংলাদেশের চলমান সম্পর্কে ফাটল ধরাতে ক্রিকেটকে বেছে নিয়েছে কিনা, জানা দরকার।

সাধারণ বা অসাধারণ যেভাবেই বলি- ক্রিকেট নিয়ে ভারতের সৃষ্ট কয়েকটি ইরিটেটিং ঘটনা যে নিছক বাংলাদেশকে কোনো না কোনোভাবে উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যেই তৈরি এটি বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধিমান হবার দরকার হয় না।

উদাহরণ চাইলে বাংলাদেশকে উদ্দেশ্য করে নির্মিত ভারতের ‘মওকা মওকা’ ভিডিওটির কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায়। কতটা হীন এবং শয়তানি দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি স্বাধীন দেশকে বিবেচনা করলে এমন একটি ভিডিও ওইরকম একটি উত্তেজনাকর মুহুর্তে ইন্টারনেটে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারে!

আমরা কীসে আনন্দ প্রকাশ করবো, আহ্লাদে আটখানা হবো আর কীসে  ব্যথিত হবো, তা-ও নির্ধারণ করবেন আপনারা? স্বাধীনতা যুদ্ধে আপনাদের সহযোগিতার কথা আমরা ভুলে যাইনি। অধিক মনে রেখেছি বলেই আপনাদের সব সময় বন্ধুই ভাবি। আর বন্ধু ভাবি বলেই অনেক সময় মর্যাদার আসনটি আমাদের নিজেদের জন্য না রেখে আপনাদের জন্যে রাখি।

উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, যখন আপনাদের অমর্ত্য সেন নোবেল পেলেন, তখন আমরা আনন্দে উদ্বেলিত হলাম। এই ভেবে যে, ভারতের কেউ নোবেল পাওয়া মানে বাংলাদেশ পাওয়া। আমরা তাই সম্মানিত নোবেল লরিয়েটকে আরও বেশি মর্যাদাবান করতে নানাভাবে আমন্ত্রণ করতে লাগলাম। বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা তার যেকোনো মন্তব্যকে ভগবানের বাণীর মতো কান পেতে শুনতে লাগলাম।

সত্যিকার অর্থে, আমরা যে কতোটা বন্ধু পরায়ণ তা আরও নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে বোঝানো যায়। যেমন- আমাদের নিজেদের অনেক টিভি চ্যানেল থাকার পরও আমাদের ঘরে ঘরে আপনাদের চ্যানেলগুলোই সারাক্ষণ চলে। আপনাদের বাংলা-হিন্দি সিরিয়াল না দেখে ঘুমাতে পারে না আমাদের বউ-শাশুড়িরা। এমনকি এসব সিরিয়াল দেখে দেখে ঘরোয়া রাজনীতির জটিল কূট-কৌশল শিখে আমাদের অনেক পরিবারে অশান্তির বীজ গজাতে থাকলেও আমরা উদার। তারপরও প্রশ্ন করতে পারি না, দিনের পর দিনে আপনাদের হিন্দি-বাংলা সব চ্যানেল আমাদের ঘরে শিকড় বিস্তার করলেও আমাদের চ্যানেলগুলো আপনারদের ওখানে চলতে হাজারো বিপত্তি কেনো?

ক্রিকেট নিয়ে বলি, দিনের পর দিন আমরা আপনাদের আজহার উদ্দিন, সুনীল গাভাস্কার, শচীন টেন্ডুলকার আর সৌরভ দাদাদের ছবি আমাদের ঘরে ঘরে পূজার ঠাকুরের মতো টাঙিয়ে রেখেছি। এমনকি আপনাদের ক্রিকেট বরপুত্রদের মুত্র-গন্ধকেও আমরা আঁতরের গন্ধের মতো ভালোবেসেছি, পরম আদরে গায়ে মেখেছি। দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তের মাঠে আপনাদের তিরঙ্গা পতাকা দেখে অনুচিত উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছি।


জয়ের এই আনন্দ প্রতিটি ছক্কার মারের সাথে সাথে জুমার নামাজের সময়ও উচ্চচিৎকারে ‘ছক্কা’ বলে হৈ হৈ-রৈ রৈ করেছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। পোস্টার, ব্যানার, ক্যাপ, টিশার্ট, বেলুন উড়িয়ে... কোথায় রাখি নাই আপনাদের? আমাদের মিডিয়াগুলো চরম গুরুত্বপূর্ণ সংবাদকে ভেতরের পাতায় ছেপে আপনাদের সংবাদকে বড় পয়েন্ট টাইপে লাল ব্যানার  হেড করে প্রথম পাতায় ছেপেছে। কোনো কোনো পত্রিকাতো রীতিমত রীতি ভঙ্গ করে তিলকে তাল করে আপনাদের ক্রিকেটকে মেলে ধরেছে আমাদের উন্মাদ ক্রিকেট ভক্তদের কাছে।  

কই, তখন তো আপনারা এই উচ্ছ্বাসের  বিরুদ্ধে কলম চালাননি? অভিযোগ করে বলেননি, ‘ভারতের জয়ে উল্লসিত হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা?  বলেননি ‘আহ্লাদে আটখানা’ হয়েছে বাংলাদেশ?

আমরা জানি, পাকিরা আমাদের জন্ম শত্রু। আর আমরা এও জানি যে, আপনারা ‘মহামতি ভারতীয়রা’ আমাদের পরম বন্ধু। স্রেফ সে কারণে আমাদের কেউ কেউ ক্রিকেটে পাকিদের সমর্থন করলে আমরা তাকে অন্যচোখে দেখতাম...এখনো তেমনটি হচ্ছে। যেমন-আমাদের রুবেলকে নিয়ে পাকি এক সাবেক ক্রিকেটারের দেওয়া ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে আমারা কীরূপ প্রতিবাদ করছিলাম। যে লোকটি কখনোই ক্রিকেট দেখে না, তিনিও এই পাকির বিরুদ্ধে দুকলম লিখেছেন, ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন- ‘সামনে পেলে ওই শালার জান নিয়া নিবো।’ এমন অনুচিত কিন্তু প্রতিবাদী উচ্চারণ থেকে স্পষ্ট হয়- দেশপ্রেম কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না। আর দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে ভারত কি কোনোভাবেই আমাদের চেয়ে বেশি উদারতা দেখিয়েছে কখনো?

আপনারা বলেছেন, “এত রাগ? কিসের রাগ বা কেন এই অসঙ্গত রাগ তা নিয়ে দু`ছত্র বলতে বললে অনেকেই পারবেন না।”

তাহলে বলি- এমনকি বছরের পর বছর ধরে বিএসএফের গুলিতে আমাদের নিরীহ লোকেরা মরেন। তারা গুলি করে মেরে কাঁটাতারের বেড়ায় আমাদের দুর্ভাগা কিশোরী ফেলানীকে ঝুলিয়ে রাখে। বিশ্ব মিডিয়ায় সে ছবি নিয়ে আলোড়িত হয়, আমাদের কোমল হৃদয়ে সংগোপনেই আমরা ফেলানী নামের মেয়েটির ছবি ঝুলিয়ে রাখি। আপনাদের বিএসএফ আমাদের এক যুবককে ধরে নিয়ে উলঙ্গ করে পিটিয়ে মনের হিংস্র ক্ষুধা মেটায়। এই বিভৎস ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ছেড়ে আবার অপনারা যথারীতি তামাম বিশ্বকে জানান। আমরা সেই চরম নির্মম অমানবিক দৃশ্যটি দেখে আহা উহু করি, বুকের ভেতরে চাপা কান্না জমিয়ে রাখি। তবু কোনো কড়া প্রতিবাদ পর্যন্ত করি না। আর ‘রাগ’ কোথায় দেখলেন?

কোনো ঘটনা এলেই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে আপনাদের সাহায্য করার কথা মনে করিয়ে খোঁচা মারেন। ইশারাতে বিশ্বকে জানিয়ে দেন- আমরা বাংলাদেশিরা আপনাদের করুণায় স্বাধীন হয়েছি। সুতরাং আপনাদের অনুমতিসাপক্ষে আমাদের কাঁদতে হবে, হাসতে হবে এমনকি আনন্দ-উচ্ছ্বাস করতেও আপনাদের সেন্সর লাগবে!  


কিন্তু; দাদারা, এইসব খোঁচা, ইরিটেটিং আর কাহাতক সহ্য করা যায়? যে ক্রিকেট বিশ্বকাপ নিয়ে আপনাদের এতো হিংসা-বিদ্বেষ সেই আনন্দ আয়োজনের সমাপ্তি হয়েছে আজই। তবুও সেই ভিডিও, আপনাদের পত্রিকার ভাষা, রুচিহীন তথ্য সন্ত্রাস, রুপমের ফেসবুক স্ট্যাটাস আমাদের মনে থাকবে বহুদিন। কিন্তু আপনাদের মতো তথ্যহীন বিদ্বেষ ছড়ানোর পরিবর্তে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অনুবাদ করা দার্নিক শেখ সা’দীর বিশ্বখ্যাত কবিতার দুটি লাইন মনে করে সান্ত্বনা পাই-
‘কুকুরের কাজ কুকুর করেছে
কামড় দিয়েছে পায়,
তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে
মানুষের শোভা পায়?’

নিউজবাংলাদেশ.কম/কেজেএইচ

নিউজবাংলাদেশ.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়