ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাবের পরও গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৭০
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় শনিবার (৪ অক্টোবর) ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর লাগাতার হামলায় অন্তত ৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
এর মধ্যে গাজা সিটির তুফ্ফাহ এলাকায় একটি আবাসিক ভবনে চালানো হামলায় একসঙ্গে প্রাণ হারিয়েছেন ১৭ জন, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। সবচেয়ে কম বয়সী নিহত শিশুটির বয়স মাত্র ৮ মাস।
নিহতদের মধ্যে তিনজন ত্রাণ প্রত্যাশী ছিলেন বলে জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
এর আগের রাতে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া ২০ দফা শান্তি প্রস্তাবের কিছু শর্তে সম্মতি জানায়। হামাসের এই ঘোষণার পরপরই ট্রাম্প ইসরায়েলকে গাজায় বোমাবর্ষণ বন্ধের নির্দেশ দেন। তবে তার নির্দেশ উপেক্ষা করে শনিবার দিনভর ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় হামলা চালিয়ে যায়।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শনিবারের হামলায় নিহতদের মধ্যে অন্তত ৪৫ জন দুর্ভিক্ষপীড়িত গাজা শহরের বাসিন্দা। দক্ষিণ গাজার আল-মাওয়াসি এলাকায় একটি বাস্তুচ্যুত শরণার্থী শিবিরে চালানো হামলায় দুই শিশুসহ আহত হয়েছেন অন্তত আটজন।
উল্লেখ্য, ইসরায়েলি বাহিনী ফিলিস্তিনিদের তথাকথিত নিরাপদ অঞ্চল হিসেবে আল-মাওয়াসিতে যেতে নির্দেশ দিয়ে আসছিল, অথচ সাম্প্রতিক সময়গুলোতে অঞ্চলটিকে বারবার লক্ষ্য বানাচ্ছে তারা।
স্থানীয় চিকিৎসকদের বরাতে জানা গেছে, তুফাহ এলাকার আবাসিক ভবনে চালানো হামলায় অন্তত ১৮ জন নিহত হয়েছেন এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন। আশেপাশের ভবনগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার এক বিবৃতিতে জানানো হয়, নিহতদের মধ্যে দুই মাস থেকে আট বছর বয়সী সাত শিশু রয়েছে।
আল জাজিরার সাংবাদিক হিন্দ খোদারি জানিয়েছেন, মধ্য গাজার নুসাইরাত শরণার্থী শিবিরসহ অন্যান্য এলাকাতেও বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।
তিনি বলেন, হতাহতদের চিকিৎসা দেওয়ার মতো সক্ষমতা নেই এখানকার হাসপাতালগুলোতে। তীব্র জ্বালানি সংকটের মধ্যে সীমিত আকারে চালু থাকা হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা কার্যত অচল।
আরও পড়ুন: গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৬৬ হাজার ২৮৮
গত ২৯ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউসে গাজা যুদ্ধ বন্ধে ২০ দফা শান্তি প্রস্তাব ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রস্তাবে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার, হামাসের কাছে থাকা জিম্মিদের মুক্তি, হামাসের অস্ত্র সমর্পণ, গাজার শাসনব্যবস্থায় হামাসের ভূমিকা না থাকা এবং ট্রাম্পের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক ‘বোর্ড অব পিস’ গঠনসহ গাজার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা পরিচালনার রূপরেখা তুলে ধরা হয়।
হামাস প্রস্তাবটি পর্যালোচনার পর শুক্রবার রাতে জানায়, তারা সব জিম্মিকে মুক্তি এবং বিনিময়ে ইসরায়েলে থাকা ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তির বিষয়ে রাজি হয়েছে। যুদ্ধবিরতি, সেনা প্রত্যাহার, ত্রাণ সরবরাহ বৃদ্ধি ও গাজা পুনর্গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাবেও তারা একমত পোষণ করেছে।
হামাস গাজার শাসনভার একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি সংস্থার কাছে হস্তান্তরের প্রস্তাবে সম্মতি জানালেও তাতে বিদেশিদের অংশগ্রহণ মানবে না বলে জানিয়েছে।
সংগঠনটির দাবি, এই সংস্থা গঠিত হতে হবে ফিলিস্তিনিদের জাতীয় ঐকমত্য এবং আরব ও ইসলামি বিশ্বের সমর্থনের ভিত্তিতে।
তবে গাজার নিরাপত্তায় ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ‘স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স’ এবং হামাসের অস্ত্র সমর্পণ সংক্রান্ত বিষয়ে সংগঠনটি কোনো মন্তব্য করেনি।
হামাস নেতা মুসা আবু মারজুক আল–জাজিরাকে বলেন, ইসরায়েলি দখলদারত্ব পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা অস্ত্র সমর্পণ করব না।
আরেক নেতা ওসামা হামদান বলেন, গাজায় বিদেশি শাসন মেনে নেবে না হামাস। শাসনভারও ফিলিস্তিনিদের দিয়েই পরিচালিত হতে হবে, অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য হলেও।
শুক্রবার রাতে হামাসের ঘোষণার পর ট্রুথ সোশ্যালে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প লেখেন, হামাসের বিবৃতির ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, তারা দীর্ঘ মেয়াদে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত। ইসরায়েলকে অবশ্যই অবিলম্বে গাজায় বোমাবর্ষণ বন্ধ করতে হবে, যাতে আমরা দ্রুত ও নিরাপদে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে পারি।
শনিবার রাতে আরেক পোস্টে তিনি লেখেন, ইসরায়েল সাময়িকভাবে বোমাবর্ষণ বন্ধ করেছে। আমি তাদের সাধুবাদ জানাই। জিম্মি মুক্তি ও শান্তিচুক্তি চূড়ান্ত করার সুযোগ দিতে তারা এটা করেছে। হামাসকে এখন দ্রুত এগোতে হবে, নয়তো সব হিসাব-নিকাশ বাতিল হয়ে যাবে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জেরুজালেমে সাংবাদিকদের বলেন, জিম্মিদের কবে ও কীভাবে ফিরিয়ে আনা হবে, তা চূড়ান্ত করতে ইসরায়েলি আলোচকেরা কাজ করবেন। হামাসকে নিরস্ত্র করা হবে, সেটা ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শর্ত অনুসারে হোক কিংবা ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানের মাধ্যমে।
ইসরায়েলের বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার লাপিদ এবং হামাসের কাছে থাকা জিম্মিদের স্বজনরাও নেতানিয়াহুকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস হামাসের অবস্থানকে ‘উৎসাহব্যঞ্জক’ বলে উল্লেখ করে বলেন, এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।
কাতার ও মিসর, যারা শুরু থেকেই মধ্যস্থতা করে আসছে, বলেছে, হামাসের ঘোষণার মধ্য দিয়ে সংঘাত বন্ধের পথ প্রশস্ত হলো।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ, জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লেন হামাসের ইতিবাচক অবস্থানকে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় পদক্ষেপ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
তুরস্কের ইস্তাম্বুল জাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামি আল–আরিয়ান বলেন, হামাস সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করছে। ট্রাম্প যদি সত্যিই যুদ্ধের ইতি টানতে আন্তরিক হন, তবে তার পরিকল্পনায় সেই পথে এগোনোর সুযোগ আছে।
গাজায় চলমান সংঘাতে শনিবার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৬৭ হাজার ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি








