গাজায় ক্ষুধা-হামলায় আরও ৭১ মৃত্যু
ছবি: সংগৃহীত
অবরুদ্ধ গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের গভীরতা আরও বাড়ছে। অনাহারে জর্জরিত ফিলিস্তিনিদের ওপর একদিকে চলছে ইসরায়েলের অব্যাহত বোমাবর্ষণ, অন্যদিকে খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছাতে পারছে না আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।
গত ২৪ ঘণ্টায় (শনিবার, ২৬ জুলাই) গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় কমপক্ষে ৭১ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অন্তত ৪২ জন ছিলেন ত্রাণ সংগ্রহে আসা অনাহারী মানুষ। একইদিনে আরও পাঁচজন প্রাণ হারিয়েছেন অবরোধজনিত ক্ষুধাজনিত কারণে।
এই তথ্য নিশ্চিত করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) এবং গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র।
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলমান অবরোধ ও সংঘাতে এখন পর্যন্ত অপুষ্টিজনিত কারণে মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৭ জনে, যাদের মধ্যে ৮৫ জনই শিশু।
বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো, গত ২৭ মে থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ উদ্যোগে গঠিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF)-এর বিতর্কিত ত্রাণকেন্দ্রে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ১,১০০ ছাড়িয়েছে। এই কেন্দ্রগুলোর অবস্থান এবং সেখানে ইসরায়েলি ড্রোন নজরদারি ও আক্রমণকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
শনিবার খান ইউনিসের ‘নিরাপদ অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষিত আল-মাওয়াসি এলাকাতেও একটি শরণার্থী টেন্ট ক্যাম্পে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় ৬ জন নিহত হয়েছেন। বাস্তবে সেখানে কোনো নিরাপত্তা নেই বলে জানিয়েছে গাজার সিভিল ডিফেন্স এজেন্সি।
জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা সংস্থা জানিয়েছে, গাজায় বর্তমানে প্রতি তিনজনের একজন মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন।
সংস্থাটির মতে, সেখানে অন্তত ৯০ হাজার নারী ও শিশু জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসাসেবার প্রয়োজন রয়েছে। গাজার পরিস্থিতিকে “জীবন-ধ্বংসকারী দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে” বলে আখ্যা দিয়েছে তারা।
ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা গাজায় আকাশপথে ত্রাণ ফেলেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতও জানিয়েছে, তারা এই পথেই ত্রাণ পাঠাবে।
তবে ইউএনআরডব্লিউএ প্রধান ফিলিপ লাজারিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, এটি মূল সমস্যা থেকে মনোযোগ সরানোর ব্যয়বহুল ও অকার্যকর উপায়। খাদ্যসামগ্রী পৌঁছাতে রাস্তা খুলে দেওয়া ও নিরাপদ চলাচলের অনুমতি দেওয়াই একমাত্র বাস্তব সমাধান।
আরও পড়ুন: গাজাগামী ত্রাণজাহাজ ‘হানদালা’ ছিনতাই করল ইসরায়েল
তিনি আরও বলেন, ইসরায়েলকে অবশ্যই অবরোধ তুলে নিতে হবে, রাস্তাগুলো খুলে দিতে হবে এবং মর্যাদাপূর্ণ চলাচলের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
গ্লোবাল চাপের মুখে শনিবার রাতে ইসরায়েল ঘোষণা দেয়, রবিবার (২৭ জুলাই) থেকে তারা গাজার কিছু বেসামরিক অঞ্চল ও ত্রাণ করিডোরে সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে যাবে। তবে তারা স্পষ্ট করেনি কোন কোন এলাকায় এই বিরতি কার্যকর হবে।
গাজা শহর থেকে আল জাজিরার প্রতিনিধি হানি মাহমুদ জানান, এ পর্যন্ত মাত্র সাতটি প্যালেটজাত ত্রাণ গাজায় ফেলেছে ইসরায়েল, যা এক ট্রাকেরও কম।
তিনি বলেন, এটা বাস্তবে কোনো সহায়তা নয়।
এই ত্রাণ ফেলা হয়েছে উত্তর গাজার সামরিক নিষিদ্ধ এলাকায়, যেখানে রাতে প্রবেশ করে সেগুলো সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব।
এই পরিস্থিতিতে ভূমধ্যসাগর হয়ে গাজায় পাঠানো মানবিক সহায়তাবাহী জাহাজ ‘হানদালা’ শনিবার রাতে গন্তব্যের প্রায় ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে ইসরায়েলি বাহিনী আটক করে। জাহাজটিতে ছিলেন ২১ জন নিরস্ত্র যাত্রী, যাদের মধ্যে ফ্রান্স ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের দুই সদস্য এবং মার্কিন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ক্রিশ্চিয়ান স্মল রয়েছেন। হানদালায় শিশু খাদ্য, ওষুধ, ডায়াপারসহ জরুরি সামগ্রী ছিল।
এই আটককে মানবতার ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে অভিহিত করেছে ফ্লোটিলা ফর ফিলিস্তিন (FFC)।
ইসরায়েল বরাবরের মতো জাতিসংঘকেই ত্রাণ পৌঁছাতে না পারার জন্য দায়ী করেছে।
তবে জাতিসংঘ, রেড ক্রস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ একাধিক সংস্থা এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, ইসরায়েল অনুমতির সঙ্কট তৈরি করেই ত্রাণ বাধাগ্রস্ত করছে।
সাহায্যকর্মীরা জানান, নিরাপদ করিডোর ও অনুমতি ছাড়া ত্রাণ প্রবেশ কার্যত অসম্ভব।
গাজার সিভিল ডিফেন্স এজেন্সি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাদের যানবাহনগুলো জ্বালানি ও যন্ত্রাংশের অভাবে খুব শিগগিরই কার্যক্ষমতা হারাবে।
সংস্থাটি বিশ্ব সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ দাবি করে বলেছে, ইসরায়েলি দখলদার কর্তৃপক্ষকে আন্তর্জাতিক চাপ দিয়ে ত্রাণ সরবরাহের জন্য সীমান্ত খুলতে বাধ্য করতে হবে।
বর্তমানে গাজার পরিস্থিতি নিছক মানবিক সংকট নয়, এটি একপ্রকার ‘নিয়ন্ত্রিত দুর্ভিক্ষ’। অনাহার, হামলা ও কূটনৈতিক নিষ্ক্রিয়তার মাঝে নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যুমিছিল প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে। ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা, জাতিসংঘের কড়া প্রতিবাদ, আন্তর্জাতিক সহায়তা—সবকিছু মিলিয়ে কার্যকর সমাধানের জায়গা এখনো অন্ধকারে। ত্রাণ নয়, প্রয়োজন বাস্তব রাজনৈতিক চাপ ও অবরোধ প্রত্যাহারের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি








