পুষ্টি চাহিদা পূরণে দুধ ও মাংস উৎপাদনে সরকারের নতুন প্রকল্প

ফাইল ছবি
জাতীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ, গ্রামীণ দরিদ্র্য হ্রাস, এবং কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থানীয় গবাদিপশুর জাত উন্নত করে দেশে দুধ ও মাংস উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে ‘দুধ ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রুভেন বুল উৎপাদন’ শীর্ষক একটি পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়নে যাচ্ছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি শুরু হচ্ছে ২০২৫–২৬ অর্থবছর থেকেই এবং চলবে ২০২৯–৩০ অর্থবছর পর্যন্ত।
৬৯ কোটি টাকা ব্যয়ে পরিচালিত এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। চারটি বিভাগের ১৮টি জেলার ৯৩টি উপজেলায় এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রকল্পের আওতায়, দেশি-ফ্রাইজিয়ান, দেশি-সাহিওয়াল ক্রস, লাল চট্টগ্রাম, পাবনা, মুন্সীগঞ্জ এবং উত্তরবঙ্গের ধূসর জাতের ৪০০টি ষাঁড় বাছুর সংগ্রহ করা হবে, যাদের মাতৃ গাভীগুলোর গড় দুধ উৎপাদনের ভিত্তিতে বাছাই করা হবে। এর মধ্যে ২০০টি কর্মক্ষম ও উচ্চ সম্ভাবনাময় ষাঁড় নির্বাচিত হবে ‘বাছাইকৃত ষাঁড়’ হিসেবে। পরবর্তীতে এদের বীর্য প্রজনন মান বিশ্লেষণ করে যেসব বীর্য উৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত হবে, সেগুলোকে ‘প্রুভেন বুল’ হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হবে।
প্রকল্প পরিচালক ড. এম মোস্তাফিজুর রহমান জানান, এই ‘প্রুভেন বুল’ ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্চফলনশীল জাতের গবাদিপশু উৎপাদন সম্ভব হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে অধিক দুধ ও মাংস উৎপাদনে সহায়ক হবে। এটি প্রাণিসম্পদ উৎপাদনে একটি গেম-চেঞ্জার হিসেবে কাজ করবে।
এই প্রকল্পের আওতায় সরাসরি ৩৪,৩৭৫ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এছাড়া, ‘এলিট গরু কর্মসূচি’-র অধীনে উচ্চ উৎপাদনক্ষম গাভী মালিকদের মধ্যে ৭,৫০০ জন খামারিকে নগদ প্রণোদনা প্রদান করা হবে। উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য ব্যবহারে খামারিদের উৎসাহিত করতে টিকা, ওষুধ ও উন্নত পশুখাদ্য সরবরাহের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা নির্ধারণ হার্টের রিংয়ের দাম
প্রকল্প নথি ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে অনেক হাইব্রিড গাভী প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ লিটার দুধ দিচ্ছে। কিন্তু এই উৎপাদন বজায় রাখতে প্রয়োজন উচ্চমানের ও জেনেটিক্যালি নির্বাচিত বীর্য। অপরিকল্পিত প্রজনন ও নিম্নমানের বীর্যের কারণে গাভীর উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে এবং জাতের মানও নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে, বিশ্বমানের জেনেটিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রজননকারী ষাঁড় নির্বাচন জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রকল্পটি জাতীয় প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন নীতি ২০০৭-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উক্ত নীতিতে সঠিক জেনেটিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রজনন পশু নির্বাচন এবং দেশব্যাপী উন্নত জাতের ষাঁড়ের বিস্তারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই প্রকল্প জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে কাজ করবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য প্রতিদিন ২৫০ মিলিলিটার দুধ গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে গড় মাথাপিছু দুধ ভোগের পরিমাণ মাত্র ৩৪.১ গ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশের ১৫%–এরও কম।
গৃহস্থালী আয় ও ব্যয় সমীক্ষা ২০২২ অনুসারে, এ পরিসংখ্যান দেশের পশুপালন উৎপাদনশীলতার ঘাটতির বাস্তব প্রতিফলন।
সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে দেশে গরু ও ছাগলের প্রায় দেড় লাখ খামার গড়ে উঠেছে। দুধ উৎপাদনকারী নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত খামারের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত খামারির সংখ্যা বর্তমানে ৫ লাখ ৭৭ হাজার ৪১৬ জন। এই শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন প্রায় এক কোটি মানুষ, যা এ খাতকে দেশের অন্যতম বৃহৎ গ্রামীণ অর্থনীতিভিত্তিক শিল্পে রূপ দিয়েছে।
বর্তমানে নিবন্ধিত খামার রয়েছে ৬৬ হাজার, অনিবন্ধিত রয়েছে ৭০ হাজার, সব মিলিয়ে মোট খামার ১ লাখ ৩৬ হাজারটি।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় আশা করছে, সরকারের চলমান ও নতুন এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে দুগ্ধ উৎপাদনে দেশের ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে এবং দেশ দুধ ও মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাবে। পাশাপাশি এটি জাতীয় পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়ন, কৃষক আয়ের স্থায়িত্ব এবং রপ্তানিযোগ্য প্রাণিসম্পদ পণ্যের উৎপাদনে নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি