পাহাড়ে মসলার সুবাসে সম্ভাবনার চাষ

ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে খাদ্যের স্বাদ ও রঙের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মসলা। বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় ৬০ লাখ মেট্রিক টন মসলা আমদানি করতে হয়, যার বাজার মূল্য দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং কৃষকদের আগ্রহের কারণে বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় মসলার আবাদ সম্প্রতি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
পার্বত্যাঞ্চলে মসলার উন্নয়ন প্রকল্প এবং সাফল্য
কৃষি মন্ত্রণালয়ের ‘মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্প’ ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৪০ জেলা ও ১১০ উপজেলা ও ২৫ হর্টিকালচার সেন্টারে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটির আওতায় উচ্চ ফলনশীল জাত ও আধুনিক প্রযুক্তি চালু করে পার্বত্যাঞ্চলের কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং বীজ ও প্রযুক্তি সরবরাহ করা হচ্ছে।
বান্দরবান জেলার আদা চাষি সুজিত কুমার দাস বলেন, ৩৩ শতাংশ জমিতে তিনি ৪৫ মণ আদা পেয়েছেন এবং প্রতি মণ আদা বিক্রি করেছেন ৫ হাজার ২০০ টাকায়। যদিও বীজের দাম প্রায় ৬-৭ হাজার টাকা প্রতি মণ হওয়ায় সাধারণ কৃষকরা তা সংগ্রহে সমস্যায় পড়েন। পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনা দুর্বল ও পরিবহনে সমস্যা থাকায় কৃষকদের উৎপাদিত মসলার ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না।
বান্দরবানের সহকারী শিক্ষক মেন ইয়াং ম্রোও গোলমরিচ, দারুচিনি ও আদা চাষাবাদে গত পাঁচ বছর ধরে সাফল্য অর্জন করছেন। গোলমরিচ বিক্রি করেন প্রতি কেজি ৫০০ টাকায়। থানচি উপজেলায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৮০৮.৫০ হেক্টর জমিতে ১৬,৫৪০ মেট্রিক টন মসলা উৎপাদিত হয়েছে।
মসলার আবাদ বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
বান্দরবান কৃষি অফিসের তথ্য মতে, জেলার হলুদ চাষের জমি বর্তমানে ৪,৫০০ হেক্টর এবং আদার ক্ষেত ৩,০০০ হেক্টর, যা প্রায় ২০০ কোটি টাকার বাজার মূল্য বহন করে। ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে পার্বত্যাঞ্চলে মসলার আবাদ জমি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, যা ১,২০০ হেক্টর থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৭৫০ হেক্টরে। আদা চাষ বেড়েছে দ্বিগুণ, আর হলুদ চাষ বেড়েছে ৬৫ শতাংশ।
বাজার মূল্য ও আমদানি পরিসংখ্যান
বর্তমানে বাজারে এলাচের দাম প্রতি কেজি ৫,৫০০ টাকা, দারুচিনি ৫৫০ টাকা, হলুদ ৪৫০-৫০০ টাকা, গোলমরিচ ১,৬০০-১,৮০০ টাকা, আদা ১০০ টাকা, পেঁয়াজ ৬০ টাকা এবং রসুন ১৮০ টাকা।
আরও পড়ুন: মানিকগঞ্জে তিলের চাষ বেড়েছে ১২৬ হেক্টর
চট্টগ্রাম কাস্টমস অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এলাচ, দারুচিনি সহ ৩৪ প্রকার মসলা আমদানি হয়েছে ১,৯৯,৬৪.৪৭ মেট্রিক টন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মসলার আমদানির মূল্য ছিল ৪৭৮.৪ মিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের ৩৫৭.৯ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।
কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এম এম শাহ্ নেয়াজ বলেন, পার্বত্যাঞ্চলের জলবায়ু ও মাটি উচ্চমূল্যের মসলা চাষের জন্য আদর্শ। এলাচ ও দারুচিনি পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করে ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। তিনি আশা করেন, স্থানীয় কৃষকরা সরকারি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ পেলে ভবিষ্যতে দেশি মসলা আমদানির পরিবর্তে রপ্তানি সম্ভব হবে।
হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক লিটন দেবনাথ বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনে মসলা চাষ একটি বিশাল সম্ভাবনা। দীর্ঘমেয়াদে মসলার সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
নারীর অংশগ্রহণ ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম
মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্প নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বারোপ করে চলেছে। বর্তমানে ২৫-৩০ শতাংশ মহিলা কৃষক, বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মহিলা এই প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। ২০২৪-২৫ পর্যন্ত প্রায় ৫৯,৯১০ জন চাষিকে মসলা চাষ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
পার্বত্যাঞ্চলে মসলার আবাদ ও উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় দেশের মসলার আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানোর দিশা দেখা যাচ্ছে। সরকারি প্রকল্প, প্রশিক্ষণ ও বীজ সরবরাহের মাধ্যমে কৃষকরা আধুনিক ও লাভজনক মসলা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। বাজার ব্যবস্থাপনা ও পরিবহনে সরকারি হস্তক্ষেপ ও সমন্বয় বাড়ালে, এই অঞ্চলের মসলাজাতীয় ফসল দেশের খাদ্য ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে। দীর্ঘমেয়াদে রপ্তানি সম্ভাবনা থাকা এই খাতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি দেশকে খাদ্য ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার পথে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি