ভূমিকম্পে উচ্চ ঝুঁকিতে সিলেট-ঢাকা
ছবি: সংগৃহীত
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, সিলেট শহর ডাউকি (Dauki) এবং কপিলি (Kopili) ফল্টের সরাসরি প্রভাবে “ডেঞ্জার জোন”-এ রয়েছে, যেখানে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে নগরী ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
সিলেট শহর ডাউকি ফল্টের ঠিক ওপর অবস্থিত। শহর থেকে এই ফল্টের দূরত্ব প্রায় ৫৬.৩ কিমি। ভৌগোলিকভাবে সিলেটের দক্ষিণ প্রান্তে ডাউকি ফল্ট এবং উত্তর-পূর্বে ভুটান সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত কপিলি ফল্ট সিলেটের নিকটবর্তী।
ভূতাত্বিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কপিলি ফল্টে এখনও বিপুল শক্তি সঞ্চিত রয়েছে, যা যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটাতে পারে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জহির বিন আলম জানান, বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ। কারণ, এই অঞ্চলে বাংলাদেশ, মায়ানমার এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের মিলনস্থল অবস্থিত। তাই যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনা সর্বদা থাকে।
ভূতাত্বিক জরিপ অনুযায়ী, ১৮৯৭ এবং ১৯৮০ সালে এই অঞ্চলে বড় ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। এছাড়া ২০২১ সালের ২৯ মে একদিনে চারবার এবং ২৪ ঘণ্টায় সাতবার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৃদু কম্পন স্বাভাবিক হলেও মূল উদ্বেগ হলো কপিলি ফল্টে জমে থাকা শক্তি।
সম্প্রতি নরসিংদীর মাধবদীতে রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানেছে। এতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কম্পন অনুভূত হয়েছে। ভূমিকম্পের কারণে অন্তত ১০ জন নিহত এবং ৬ শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। উৎপত্তিস্থল ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০ কিমি গভীরে হওয়ায় ঝাঁকুনির তীব্রতা বেশি ছিল। বিশেষজ্ঞরা এটিকে সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন, বিশেষ করে সিলেট ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য। পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার আশুলিয়া ও বাইপাইলে মৃদু আফটারশক রেকর্ড করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: রাজধানীতে আবারও ভূমিকম্প অনুভূত
আবহাওয়া অধিদপ্তরের মানচিত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশকে তিনটি ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ জোনে ভাগ করা হয়েছে:
- জোন-১: উচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ (উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্ব)
- জোন-২: মাঝারি ঝুঁকিপ্রবণ
- জোন-৩: নিম্ন ঝুঁকিপ্রবণ
সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের ৯টি জেলা, ঢাকা বিভাগের টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদীর কিছু অংশ, কিশোরগঞ্জ জেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির পাহাড়ি এলাকা সর্বোচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত।
সিলেট সিটি করপোরেশন-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০২১ ও ২০২২ সালে ঝুঁকি মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
সিডিএমপি জরিপ অনুযায়ী, বড় ভূমিকম্প হলে ৩০ হাজারের বেশি ভবন ধসের আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু নগরের ৭৪.৪ শতাংশ ভবন ভূমিকম্প প্রতিরোধের জন্য নির্মাণ বিধি অনুযায়ী তৈরি হয়নি। ফলে, ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে শহরের ৮০ শতাংশ বহুতল ভবন ধসে যেতে পারে।
সিটি করপোরেশন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিরূপণে কাজ করছে। তবে, অনেক ভবন এখনও ভেঙে ফেলা বা রিকটিফাই করা হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকে ধ্বংস না করে রিক্টিফাই ও সাপোর্টিং পাওয়ার দিয়ে ভূমিকম্প প্রতিরোধক করা সম্ভব।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সরঞ্জাম এবং উদ্ধার কার্যক্রম উন্নত হলেও তা সীমিত। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভলেন্টিয়ার আছেন প্রায় ৫ হাজার জন, যা যথেষ্ট নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে পরিকল্পিত নগরায়ন, বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ এবং জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থার উন্নয়ন অপরিহার্য। এছাড়া ডাউকি ও কপিলি ফল্টের পাশাপাশি মাধুপুর এবং অন্যান্য ফল্ট লাইনের প্রতি নীতিনির্ধারকদের সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
সিলেট ও দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভূমিকম্পের দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপ্রবণ। সাম্প্রতিক ঢাকার ভূমিকম্প এবং নিয়মিত মৃদু কম্পন সতর্কবার্তা দিচ্ছে। এখনই সময় সতর্কতা, প্রস্তুতি এবং কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নেওয়ার, নয়তো ভবিষ্যতে বড় ধরনের মানবিক ও সম্পত্তিগত ক্ষতি এড়িয়ে চলা কঠিন হবে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি








