‘ভূমিকম্পে আতঙ্ক নয়, প্রস্তুতি জরুরি’
ছবি: সংগৃহীত
সাম্প্রতিক সময়ে অনুভূত হওয়া কয়েক দফা ভূমিকম্প নিয়ে জনমনে সৃষ্ট আতঙ্ক দূর করতে এবং সরকারের জরুরি করণীয় নির্ধারণে এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকরা সম্মিলিতভাবে মত দিয়েছেন যে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, বরং প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করাই এখন মূল লক্ষ্য।
গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) ও শনিবার (২২ নভেম্বর) কয়েক দফায় ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার প্রেক্ষাপটে সোমবার (২৪ নভেম্বর) প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক জরুরি সভায় বিশেষজ্ঞরা এই মতামত দেন। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বিশেষজ্ঞদের আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সরকারের করণীয় সম্পর্কে লিখিত পরামর্শ প্রদান করেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, আমরা হাত গুটিয়ে রাখতে চাই না, আবার অবৈজ্ঞানিক কোনো পদক্ষেপও নিতে চাই না। আপনাদের পরামর্শগুলো দ্রুত লিখিত আকারে আমাদের দিন; সরকার প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে প্রস্তুত।
প্রধান উপদেষ্টা আরও জানান, প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং এক বা একাধিক টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়ে কাজ চলছে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ পাওয়া মাত্রই সে অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কয়দিন আগে ভয়াবহ ভূমিকম্পে যাদের মৃত্যু হলো, যারা আহত হলেন—এটা খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। এমনটি যেন আর না হয়, তার জন্য আমাদের অবশ্যই প্রস্তুতি নিতে হবে। এই আতঙ্ক থেকে জনগণকে রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। এই পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা প্রয়োজন, সরকারকে তা জানান।
বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেন এবং সরকারের করণীয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দেন।
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন যে, ভূমিকম্পকে ঘিরে বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় বড় মাত্রার ভূমিকম্পের দিন-তারিখ-সময় নিয়ে অনেক গুজব তৈরি হয়েছে।
তারা স্পষ্ট জানান, ভূমিকম্প কখন হবে তা কেউ বলতে পারে না; কেবল ঐতিহাসিক তথ্য দেখে একটি সময়সীমা অনুমান করা যায়, কিন্তু নির্দিষ্ট দিন-তারিখ বলা যায় না।
আরও পড়ুন: ভূমিকম্প প্রস্তুতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান পরামর্শ দেন, ভূমিকম্পের উৎস ও উৎপত্তিস্থল পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ও এর আশেপাশে কতগুলো ‘সোর্স’ আছে এবং সেগুলোর কারণে ‘শেকিং লেভেল’ কী হতে পারে, তা নিরূপণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ আমরা স্বল্প ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। তবে আমাদেরকে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রাখতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আখতার জনসচেতনতা তৈরিতে তরুণদের কাজে লাগানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি ইনডোরে, আউটডোরে, ব্যক্তি পর্যায়ে ও প্রতিষ্ঠানে—এই চার স্তরে করণীয় পরিকল্পনা তৈরি করে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার এবং ন্যাচারাল হ্যাজার্ড প্ল্যান ও প্রযুক্তিগত উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন।
চুয়েটের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মন্ত্রণালয় তাদের আওতাধীন স্থাপনাগুলোর মূল্যায়ন করতে পারে।
হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ—এসব খাতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। হাসপাতালগুলোর জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সক্ষমতা মূল্যায়ন ও প্রস্তুতি নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন তিনি।
এমআইএসটি’র অধ্যাপক মো. জয়নুল আবেদীন জনগণের কাছে করণীয় সম্পর্কে আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য পৌঁছানোর ওপর গুরুত্ব দেন।
তিনি বলেন, মানুষকে মাথা ঠান্ডা রাখার বিষয়ে সচেতন করতে হবে। কোন এলাকায় খোলা জায়গা আছে, কোথায় জমায়েত হওয়া যায়—তা জানাতে হবে এবং সে অনুযায়ী মহড়া করতে হবে। বাসাবাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মহড়ার ব্যবস্থা জরুরি।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী (সিভিল) মো. খালেকুজ্জামান চৌধুরী জানান, ইতোমধ্যে একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভূমিকম্পের ফলে ফাটল ধরা ভবনের ছবি সংগ্রহ শুরু হয়েছে। দুই শতাধিক ভবনের মূল্যায়ন করা হয়েছে এবং বেশিরভাগই পার্টিশন দেয়ালে ফাটল দেখা যাচ্ছে। সফটওয়্যারটির মাধ্যমে দ্রুত মূল্যায়ন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও ভূমিকম্প-বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সমন্বয়ের পরামর্শ দেন এবং 'শুভেচ্ছা' নামে একটি অ্যাপের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার উদ্যোগের কথা জানান।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিশেষজ্ঞদের পাঠানো লিখিত সুপারিশ নিয়ে সরকার দ্রুত সময়ে আলোচনা করে টাস্কফোর্স গঠন করবে। ভূমিকম্পের বিষয়ে আশু করণীয় নিয়ে গঠিত এই টাস্কফোর্সে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা যুক্ত থাকবেন।
বৈঠকে উপদেষ্টাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, দুর্যোগ ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক আলী রিয়াজ।
এমআইএসটি’র প্রফেসর মো. জয়নুল আবেদীন; বুয়েটের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী, অধ্যাপক তাহমীদ মালিক আল-হুসাইনী, অধ্যাপক ড. তানভীর মনজুর ও অধ্যাপক ইসরাত ইসলাম; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. জিল্লুর রহমান, অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আখতার, দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ ড. মো. শাখাওয়াত হোসাইন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকিপূর্ণতা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান খান; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম; আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. মমিনুল ইসলাম; আবহাওয়াবিদ মো. রুবাইয়্যাত কবীর; এবং ভূতত্ত্ববিদ ড. রেশাদ মো. ইকরাম আলী।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি








