News Bangladesh

আন্তর্জাতিক ডেস্ক || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৯:১৪, ২১ আগস্ট ২০২৫

লোকসভায় নতুন বিল: টানা ৩০ দিন জেলে থাকলেই মন্ত্রিত্ব শেষ

লোকসভায় নতুন বিল: টানা ৩০ দিন জেলে থাকলেই মন্ত্রিত্ব শেষ

ছবি: সংগৃহীত

ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার এমন একটি বিতর্কিত বিল এনেছে, যা নিয়ে সংসদের অভ্যন্তরে ও বাইরে চরম উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এই বিল অনুযায়ী, যদি কোনো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী অথবা কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পাঁচ বছর বা তার বেশি মেয়াদের কারাদণ্ড হতে পারে এমন কোনো গুরুতর ফৌজদারি মামলায় টানা ৩০ দিন জেল হেফাজতে থাকেন, তাহলে তাকে তার পদ থেকে অপসারণ করা হবে। 

বুধবার (২০ আগস্ট) সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই সংবিধান সংশোধনী বিল-২০২৫ পেশ করার পর থেকেই বিরোধীরা এর তীব্র প্রতিবাদ শুরু করেছেন।

বিলটির মূল বিষয় হলো

  • ৩০ দিনের নিয়ম: প্রস্তাবিত বিল অনুযায়ী, ভারতের যেকোনো মন্ত্রী, যেমন প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী, যদি পাঁচ বছর বা তার বেশি কারাদণ্ডযোগ্য অপরাধে টানা ৩০ দিন ধরে গ্রেপ্তার ও আটক থাকেন, তাহলে তাকে পদ থেকে অপসারণ করা হবে।
  • স্বয়ংক্রিয় পদ বাতিল: যদি প্রধানমন্ত্রী কোনো অভিযুক্ত মন্ত্রীকে অপসারণের জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ না দেন, তাহলে ৩১তম দিনে ওই মন্ত্রীর পদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। একইভাবে, যদি প্রধানমন্ত্রী নিজেই ৩০ দিনের জন্য কারাবন্দি থাকেন, তাহলে ৩১ দিনের মধ্যে তাকে পদত্যাগ করতে হবে, অন্যথায় তার পদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে শেষ হয়ে যাবে।
  • রাজ্যের ক্ষেত্রে: রাজ্যের মন্ত্রীদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। কোনো প্রতিমন্ত্রী ৩০ দিনের জন্য কারাগারে থাকলে, মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শে রাজ্যপাল তাকে অপসারণ করবেন। যদি মুখ্যমন্ত্রী অপসারণের পরামর্শ না দেন, তাহলে ৩১তম দিনে তার পদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হবে। আর যদি কোনো মুখ্যমন্ত্রী নিজে ৩০ দিন কারাগারে থাকেন, তাহলে তাকে ৩১ দিনের মধ্যে পদত্যাগ করতে হবে, অন্যথায় তার পদও স্বয়ংক্রিয়ভাবে শেষ হয়ে যাবে।

বিলটি লোকসভায় পেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিরোধী দলের সাংসদরা প্রবল প্রতিবাদ শুরু করেন। তারা এই বিলকে ‘কালাকানুন’ এবং সংবিধানবিরোধী বলে অভিহিত করেন। প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বেশ কয়েকজন বিরোধী সাংসদ বিলের কপি ছিঁড়ে তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে ছুঁড়ে মারেন। এই হট্টগোলের কারণে সংসদ অধিবেশন মুলতবি করতে বাধ্য হন স্পিকার।

সংসদের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহসহ কয়েকজন শীর্ষ মন্ত্রী লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার সঙ্গে দেখা করেন এবং বিল ছিঁড়ে ফেলার ঘটনায় জড়িত সাংসদদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন।

বিরোধীদের অভিযোগ: গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আঘাত
বিলটির বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর মূল অভিযোগ হলো, এটি ভারতের গণতন্ত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আঘাত হানার একটি কৌশল। 
তাদের মতে, এই আইনের মাধ্যমে বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হবে।

প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রা (কংগ্রেস): তিনি বলেন, এই বিল পাস হলে মিথ্যা অভিযোগে কোনো মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করে ৩০ দিন পর দোষী প্রমাণিত না হয়েই তাকে পদ থেকে অপসারণ করা সম্ভব হবে। তিনি এই বিলকে সম্পূর্ণ সংবিধানবিরোধী, অগণতান্ত্রিক এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থার নামে একটি লোক দেখানো পদক্ষেপ বলে সমালোচনা করেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী): তিনি বিলটিকে ‘হিটলারি কায়দা’ আখ্যা দিয়ে বলেন, এটি জরুরি অবস্থার চেয়েও ভয়াবহ। 

তিনি আরও বলেন, এই বিলের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট যাদের ‘খাঁচায় বন্দি তোতা’ বলেছিলেন, সেই ইডি ও সিবিআইয়ের হাতে অপরিসীম ক্ষমতা তুলে দেওয়া হচ্ছে। এটি বিচারব্যবস্থার অধিকার খর্ব করার একটি চেষ্টা এবং গণতন্ত্রের জন্য একটি মৃত্যুঘণ্টা।

আসাদুদ্দিন ওয়াইসি (এআইএমআইএম): তিনি অভিযোগ করেন, ভারতকে একটি পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র চলছে এবং বিলটিকে হিটলারের গোপন পুলিশ বাহিনী গেস্টাপো-র সঙ্গে তুলনা করেন।

এম এ বেবি (সিপিএম): তিনি এই বিলকে বিজেপির ‘নয়া ফ্যাসিবাদ’ বলে অভিহিত করেছেন।

এই বিলটি নিয়ে আইনি এবং সাংবিধানিক বিতর্ক শুরু হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, প্রচলিত আইন অনুযায়ী একজন ব্যক্তি দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ বলে বিবেচিত হন। কিন্তু এই বিল সেই নীতির পরিপন্থী। 

বিলটি অনুযায়ী, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত না করেই কেবল ৩০ দিন কারাবন্দি রাখার অজুহাতে তার মন্ত্রিত্ব কেড়ে নেওয়া হবে।

এই বিলটি পাস করাতে সংসদের উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। লোকসভা ও রাজ্যসভায় এখনো সরকার ও তাদের সহযোগী দলগুলোর দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, যা বিলটি পাস হওয়ার পথে একটি বড় বাধা হতে পারে।

এই বিলের ভবিষ্যৎ কী হবে এবং এটি শেষ পর্যন্ত আইনে পরিণত হবে কি না, তা জানতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটি ভারতের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ইতিহাসে একটি নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, যা ভবিষ্যতে আরও আলোচনার জন্ম দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।

নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়