News Bangladesh

নিউজ ডেস্ক || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৯:২০, ২৩ আগস্ট ২০২৫

বিপজ্জনক মোহাম্মদপুর: তুচ্ছ ঘটনায় হত্যাকাণ্ড

বিপজ্জনক মোহাম্মদপুর: তুচ্ছ ঘটনায় হত্যাকাণ্ড

ফাইল ছবি

চলতি বছরের শুরু থেকেই রাজধানীর মোহাম্মদপুর জোনে কিশোর ও যুবক গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য এবং তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। 

খেলার হার-জিত, কথা কাটাকাটি, চায়ের দোকানে আড্ডা কিংবা সামান্য বিরোধ—এসব অতি সাধারণ বিষয় এখন প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানায় মোট ৯টি হত্যা মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর থানায় ৭টি এবং আদাবর থানায় ২টি মামলা।

এই হত্যাকাণ্ডগুলোর পেছনের কারণগুলো প্রায়শই অবিশ্বাস্য রকমের সামান্য।

১৬ জুলাই: আদাবর নবোদয় এলাকায় ডিম ভাঙার ঘটনা কেন্দ্র করে ডিম দোকান কর্মচারী সুজন শিকদারের চাচা ও প্রাইভেটকার চালক ইব্রাহীমকে (২৯) হত্যা করা হয়। স্থানীয়রা হামলাকারী সজীব ও রুবেলকে আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।

একই দিনে সন্ধ্যায় চাঁদ উদ্যানের লাউতলায় পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আল-আমিন (৩০) নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

২৬ জুলাই: রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী ১ নম্বর গেটে পূর্ব শত্রুতার কারণে ফজলে রাব্বী সুমন (২৬) নিহত হন।

৮ জুন: শনির আখড়ায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়াকে কেন্দ্র করে তর্কের এক পর্যায়ে চালক নাঈম হোসেন (২৫) নিহত হন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, হত্যাকারীদের বড় অংশই মাদকাসক্ত এবং পুনরায় জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এই পুনরাবৃত্তি সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

ঢাকায় প্রায় ৮০টি সক্রিয় গ্যাং বাহিনী রয়েছে, যাদের অধিকাংশই বয়সে ১৮ বছরের বেশি। এরা চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, জমি দখল, ইন্টারনেট ও কেবল টিভি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ নানা অপরাধে লিপ্ত। 

আরও পড়ুন: মোহাম্মদপুর থানা: ওসির ছত্রছায়ায় অস্ত্র-মাদক-ঘুষের রাজত্ব

পুলিশের বিশেষ ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এসব গ্যাং-এর সদস্যরা প্রায়শই মাদকাসক্ত এবং জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ফলে এক গ্যাংয়ের সদস্য গ্রেফতার হলে নতুন করে অন্য গ্যাং সক্রিয় হয়ে ওঠে।

ডিএমপি তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার ইবনে মিজান বলেন, আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে সন্ত্রাসী ও হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে আদালতে পাঠাচ্ছি। তবে হত্যাকারীদের দ্রুত বিচার না হওয়ায় এবং রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রভাবের কারণে এরা আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, হত্যা ও সন্ত্রাসের ঘটনা দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া, প্রতিশোধপরায়ণতা এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের সামাজিক আচরণের কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদেশি সিনেমা ও গ্যাং কালচারের প্রভাবও তরুণ সমাজকে নতুন গ্যাং তৈরি করতে প্ররোচিত করছে। 

তিনি আরও বলেন, সহনশীলতার অভাব এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অবনতি সমাজে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে।

মোহাম্মদপুরের পাশাপাশি আদাবর, দারুস সালাম, মিরপুর, পল্লবী ও উত্তরা অঞ্চলেও কিশোর ও যুবক গ্যাংয়ের কার্যক্রম তীব্র। ঢাকা শহরের প্রতিটি থানায় প্রায় ৫০০–১০০০ সদস্যের গ্যাং উপস্থিত। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারাদেশে ১,৯৩০ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে জুন মাসে সর্বোচ্চ ৩৪৩ জন। অর্থাৎ দেশে গড়ে প্রতিদিন ৯ জনের বেশি মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলেছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বিশেষ অভিযান ও নজরদারি চলছে। তবে দ্রুত বিচার, জামিনে মুক্তির পর পর্যবেক্ষণ, পুনর্বাসন ব্যবস্থা এবং সামাজিক সচেতনতা ছাড়া সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধান করা সম্ভব নয়। 

ড. তৌহিদুল হক বলেন, যুবসমাজের মানসিকতা পরিবর্তন এবং পারিবারিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা অপরিহার্য। সমাজের প্রতিটি স্তরে সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা ফেরানো না গেলে এই হত্যাকাণ্ড রোধ করা কঠিন হবে।

মোহাম্মদপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে কিশোর ও যুবক গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য এবং তুচ্ছ ঘটনায় হত্যার ধারা জনজীবনে আতঙ্ক বৃদ্ধি করছে। পুলিশ অভিযান, নজরদারি, সামাজিক সচেতনতা এবং দ্রুত বিচার ব্যবস্থা ছাড়া এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন।

নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়