News Bangladesh

নিউজ ডেস্ক || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৮:৪১, ৭ নভেম্বর ২০২৫

৭ নভেম্বর: জাতীয় ঐক্যের বিপ্লব ও সংহতি দিবস

৭ নভেম্বর: জাতীয় ঐক্যের বিপ্লব ও সংহতি দিবস

ছবি: সংগৃহীত

আজ শুক্রবার, ৭ নভেম্বর—ঐতিহাসিক জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে যখন সমগ্র জাতি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মুখে, তখন সিপাহি-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়ে সৃষ্টি করে দেশপ্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এদিন বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, যাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে সিপাহি-জনতা। তিনি পরবর্তীতে দেশে প্রবর্তন করেন বহুদলীয় গণতন্ত্র, উৎপাদনমুখী রাজনীতি ও উন্নয়নের নবধারা।

এই ঐতিহাসিক দিনের তাৎপর্যে আজও জাতি স্মরণ করে ‘সিপাহি-জনতার মিলিত বিপ্লব’কে, যা আধিপত্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, একদলীয় শাসন ও নৈরাজ্য থেকে দেশকে মুক্ত করেছিল।

ঐতিহাসিক দিনটি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ১০ দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আজ সকাল ৬টায় নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশের দলীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে কর্মসূচির সূচনা হয়।

বেলা ১০টায় দলের নেতাকর্মীরা সাবেক রাষ্ট্রপতি ও শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ করেন। বিকেল ৩টায় ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শোভাযাত্রা বের করা হয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও একই দিনে শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

দিবসটি উপলক্ষ্যে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনসমূহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে—

  • ৫ নভেম্বর: শ্রমিক দলের আলোচনা সভা
  • ৮ নভেম্বর: ছাত্রদলের আলোচনা সভা এবং টিএসসিতে আলোকচিত্র প্রদর্শনী
  • ৯ নভেম্বর: ওলামা দলের উদ্যোগে এতিম শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ
  • ১০ নভেম্বর: তাঁতী দলের আলোচনা সভা
  • ১১ নভেম্বর: কৃষক দলের আলোচনা সভা
  • ১২ নভেম্বর: বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বিএনপির কেন্দ্রীয় আলোচনা সভা
  • ১৩ নভেম্বর: সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস)-এর সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

এ ছাড়া ৬ থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপি ডকুমেন্টারি, ভিডিও ও স্থিরচিত্র অনলাইনে (ফেসবুক, ইউটিউব, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায়) প্রকাশ করবে বলে দলীয় সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে।

দিবসটি উপলক্ষ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক বাণীতে বলেন, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার মহিমান্বিত আত্মদানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্টরা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। মানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের মুক্তির পথ প্রসারিত হয়েছে। এখন চূড়ান্ত গণতন্ত্রের চর্চার জন্য অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনসহ গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত—মানুষের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

আরও পড়ুন: বিপ্লব ও সংহতি দিবস নিয়ে তারেক রহমানের বার্তা

তিনি আরও বলেন, ৭ নভেম্বর জাতির ইতিহাসে এক অনন্য তাৎপর্যমণ্ডিত দিন, যেদিন স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষায় সিপাহি-জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে নেমেছিল।

এক বিবৃতিতে জামায়াতে ইসলামির আমির ডা. শফিকুর রহমান ৭ নভেম্বর যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। তখন দেশপ্রেমিক সৈনিক ও জনতা ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিয়ে রাজপথে নেমে ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেন।

তিনি সতর্ক করে বলেন, জাতি আজও গভীর সংকটে ফ্যাসিবাদ পুনরায় ফিরে এলে জাতি এক মহাসংকটে পড়বে। তাই দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা, বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সকল দল-মত, বর্তমান সরকার ও সামরিক বাহিনীকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের দিনটি

১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৬ নভেম্বর সময়কালে দেশে কার্যত সরকার ছিল না, এমন অচলাবস্থার পর ৭ নভেম্বর ভোরে পাল্টা অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে। 

সে সময় আর্মি হেডকোয়ার্টারে অবস্থানকারী এক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় বলেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সায়েমের শপথের পর তিনি সেনানিবাসে ফিরে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছিলেন। সেই সময় সেনানিবাসে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র নামে এক প্রচারপত্র ঘুরছিল, যাতে দাবির মধ্যে ছিল সেনাবাহিনীতে কোনো অফিসার থাকবে না এবং ব্যাটমেন প্রথা বন্ধ করতে হবে। মধ্যরাতের পর শুরু হয় গোলাগুলি; জানা যায়, মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যুত্থান শুরু হয়েছে।

বর্ণনা অনুযায়ী, আমি দেখি কালো পোশাক ও বেসামরিক পোশাকে শতাধিক লোক জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিতে দিতে জেনারেল জিয়ার বাড়িতে ঢুকছে। তাকে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত অবস্থায় উদ্ধার করে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয়।

অল্প সময়ের মধ্যেই খবর আসে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা ও লে. কর্নেল হায়দারকে শেরেবাংলা নগরে ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা।

দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারিতে সেই সময় উপস্থিত ছিলেন কর্নেল আমিনুল হক, সুবেদার মেজর আনিস, ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী এবং অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল তাহের। তাহের তখন জিয়াকে রেডিও স্টেশনে যাওয়ার অনুরোধ করেন, কিন্তু অন্যান্য অফিসাররা বাধা দেন। উত্তপ্ত বিতর্কে তাহের রাগান্বিত হয়ে স্থান ত্যাগ করেন।

পরে রেডিওতে প্রচারের জন্য জিয়াউর রহমানের একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা রেকর্ড করে পাঠানো হয়, যা পরবর্তীতে প্রচারিত হয়।

আর্মি হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে জিয়া, মীর শওকত ও অন্য কর্মকর্তারা অভ্যুত্থানকারীদের শান্ত করতে উদ্যোগ নেন। সৈন্যদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে জিয়া একপর্যায়ে কোমরের বেল্ট খুলে মাটিতে ছুড়ে দিয়ে বলেন, এত দাবিদাওয়া থাকলে আমি আর আর্মি চিফ থাকতে চাই না।

এরপর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। যশোর থেকে পদাতিক সৈন্য এনে ঢাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।

ঐ সময়ের প্রত্যক্ষ বর্ণনা অনুযায়ী, ঢাকা সেনানিবাসের সৈনিকদের যদি সেদিন নিয়ন্ত্রণে আনা না যেত, তবে সারা দেশে নেতৃত্বহীন ভয়াবহ উচ্ছৃঙ্খল শ্রেণীসংগ্রাম শুরু হয়ে যেত।

অভ্যুত্থানে মূলত আর্টিলারি, ল্যান্সার, আর্মার, সিগন্যাল, অর্ডন্যান্স ও সাপ্লাই কোরের সৈন্যরা অংশ নেয়। ঢাকার পদাতিক বাহিনী এতে সক্রিয় না হলেও প্রতিরোধও করেনি।

জিয়ার দৃঢ় নেতৃত্বে সেনানিবাস ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনা হয়। পরবর্তীতে তার আহ্বানে দেশ ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার পথে ফিরে আসে এবং প্রতিষ্ঠিত হয় বহুদলীয় গণতন্ত্রের ভিত্তি।

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস তাই শুধু একটি রাজনৈতিক দিন নয়—এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সামরিক ইতিহাসে স্থিতিশীলতা, নেতৃত্ব ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। বিএনপি ও বিভিন্ন সংগঠন এদিনকে স্মরণ করছে জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অঙ্গীকার পুনর্নবীকরণের মাধ্যমে।

নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়