মোহাম্মদপুর থানা: ওসির ছত্রছায়ায় অস্ত্র-মাদক-ঘুষের রাজত্ব

ছবি: নিউজবাংলাদেশ
মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আলী ইফতেখার হাসানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অবৈধ আর্থিক লেনদেন, মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশ এবং মামলাবাজির একের পর এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠলেও এখনো দৃশ্যমান কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং তার প্রভাব ও একটি প্রভাবশালী অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারের মদদে বারবার রক্ষা পেয়েছেন তিনি—এমন অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরের একাধিক সূত্রের মুখেও উঠে আসছে।
মো. আলী ইফতেখার হাসান নিজেকে ‘ডিএমপির সবচেয়ে প্রভাবশালী ওসি’ হিসেবে পরিচয় দিলেও তার বিরুদ্ধে একের পর এক গুরুতর অভিযোগ উঠছে: অস্ত্র-ও-মাদক মামলা লেনদেন, ঘুষের বিনিময়ে মামলা ম্যানিপুলেশন, নিরীহদের ফাঁসানো, এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের আড়াল দেওয়া।
২০২৪ সালের নভেম্বরে সেনাবাহিনীর একটি দল মোহাম্মদপুরের বুড়িগঙ্গা পাম্পে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও গুলিসহ দুজনকে আটক করে। অভিযানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অস্ত্রধারীদের মোতায়েন করেছিলেন শামিম বেপারি—পাম্পটির দখলদার, যিনি পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা শাহিন বেপারির ভাই। সেনাবাহিনী শামিমকে প্রধান আসামি করে মামলা করতে বললেও ওসি ইফতেখার টেলিফোনে জানিয়ে দেন, শামিম ঘটনাস্থলে না থাকায় তাকে আসামি করা যাবে না। পরে ওসি নিজের মতো করে মামলা করে শামিমকে বাদ দেন।
অভিযোগ রয়েছে, এর বিনিময়ে তিনি শামিমের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেন। আটককৃতদের বিরুদ্ধেও কোনো রিমান্ড হয়নি, বরং ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায়।
২০২৫ সালের ৬ মে রাত ১২টা ৪০ মিনিটে জেনেভা ক্যাম্প থেকে মো. সাদ্দাম নামে একজনকে ১০০ গ্রাম হেরোইনসহ গ্রেপ্তার করা হয় বলে একটি খসড়া এফআইআরে উল্লেখ ছিল। ডিউটি অফিসার এসআই শামিম মামলার প্রস্তুতিপত্রও থানার অভ্যন্তরীণ গ্রুপে শেয়ার করেন।
তবে পরদিন আদালতে দেখা যায়, সাদ্দামের বিরুদ্ধে আসামি করা হয়েছে পুরোনো একটি ছিনতাই মামলায়—অথচ মূল মাদক মামলা গায়েব।
থানার ভেতরের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হেরোইনসহ গ্রেফতারের পর মামলার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়, কিন্তু এসআই রাজু জানতে পারেন, তাকে ফরওয়ার্ডিং দিতে নিষেধ করা হয়েছে। পরিবর্তে সাদ্দামকে পুরোনো মামলায় চালান করা হয়। থানার সূত্র জানায়, ওসি ইফতেখারের নির্দেশেই মামলাটি সাজানো হয়।
১৬ এপ্রিল একইভাবে বাসা থেকে ডেকে এনে সৈয়দপুরিয়া বাবুকে পুলিশ আটক করে।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, তাকে তল্লাশি করেও কিছু পাওয়া যায়নি। পরে বাবুর পরিবারের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা দাবি করা হয়, যাতে পুরোনো মামলায় চালান দেওয়া হয়। পরিবার টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তার বিরুদ্ধে ১০০ গ্রাম হেরোইনের মামলা দেওয়া হয়।
থানার সাবেক এসআই মাসুম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় একাধিক কিশোর গ্যাং বিরোধী অভিযানে সফল হন। এতে ‘বাটালি গ্রুপ’ নামে একটি গ্যাংয়ের বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন। পরে ওসির মদদে মাসুম ও তার ফোর্সকে পরিকল্পিতভাবে জনতার ‘মব’-এর মুখে ফেলে দেওয়া হয় এবং তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: ‘বিক্ষোভকারীদের সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশ দেয় হাসিনা’
জেনেভা ক্যাম্পে ‘বুনিয়া সোহেল’ ও ‘চুয়া সেলিম’ নামের দুই শীর্ষ মাদক কারবারির ছত্রছায়া নিশ্চিত করতে ওসি ইফতেখার গড়ে তোলেন চার এসআই ও এক পরিদর্শক নিয়ে একটি ‘সিন্ডিকেট’। এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা হলেন এসআই আলতাফ, মল্লিক, মাহিদুল, মোশারফ ও পরিদর্শক (অপারেশন)।
স্থানীয়দের দাবি, মাদক বিক্রির সুনির্দিষ্ট ‘সিরিয়াল’ দিয়ে খুচরা বেচাকেনা চলে এবং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অর্থ আদায় হয় ওসির জন্য।
অভিযোগ আছে, সোহেলের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা আদায়ের পরও ওসির সহায়তায় সে ফের মাদক ব্যবসায় সক্রিয় হয়ে ওঠে।
স্থানীয়দের ভাষায়, “রাত ১১টার পর দোকান খোলা রাখলেই দিতে হয় চাঁদা,” আর এসব অর্থ বিভিন্ন হাত ঘুরে যায় ওসির পকেটে। সড়ক দখল করে ব্যবসা স্থাপন, ফুটপাতের ‘টোলবাজি’, হোটেল-মার্কেট-ফলের দোকান থেকে মাসিক চাঁদা উঠিয়ে সিন্ডিকেট চালায় রিংকু, আল আমিন, মোল্লা রুবেল প্রমুখ, যাদের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও।
মোহাম্মদপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী এজাজকে সেনাবাহিনী আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। ওসি বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তাকে একটি সামান্য ‘ডাকাতির প্রস্তুতি’ মামলায় চালান দেন। ফলে সেদিনই জামিনে ছাড়া পেয়ে যায় এজাজ। রাতেই আবার তাকে আটক করে ডিবি পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করে, যেখানে পরে তার মৃত্যু হয়।
আরেক বিস্ময়কর ঘটনায়, সাংবাদিকদের একটি রিপোর্ট প্রকাশের জেরে তাদের নাম এজাহারে ঢোকান ওসি ইফতেখার।
পরে মামলার বাদী নূর মোহাম্মদ জানান, তার অজান্তে এজাহারে অতিরিক্ত নাম ঢুকেছে বলে তিনি মামলা করেননি। সাংবাদিকরা বিষয়টি জানতে পেরে এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে মামলা বন্ধ হয়।
আলামত, ভিডিও ফুটেজ ও থানার ভেতরের গ্রুপ বার্তা বিশ্লেষণে প্রমাণ মেলে যে, ৭ মে ২০২৫-এর তথাকথিত হেরোইন মামলায় আগে ড্রাফট প্রস্তুত হয়েছিল, চালান তৈরি হয়েছিল, এমনকি আদালতে পাঠানোর রেজিস্ট্রার বইয়ে নাম তোলা হয়েছিল, তবু শেষমেষ আসামির নাম কেটে ‘ছিনতাই মামলায়’ চালান করা হয়। এমনকি সাদ্দামের আসামি সিরিয়াল নম্বর, মামলার কপি ও জিডি নম্বর সব ছিল নিয়মমাফিক, তবু তা আদালতে ব্যবহার হয়নি।
ওসি ইফতেখারকে ঘিরে আরেকটি সমালোচনার কেন্দ্র হচ্ছে তার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ‘ছাতা’।
ডিএমপির প্রশাসন শাখার এক অতিরিক্ত কমিশনারের নিজের এলাকার লোক হওয়ায় ওসির বিরুদ্ধে এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি বহাল তবিয়তে আছেন। অথচ সাম্প্রতিক একটি অভিযানে সংশ্লিষ্ট পরিদর্শক (তদন্ত) হাফিজুর রহমানকে তদন্ত ছাড়াই ‘ক্লোজ’ করা হয়।
ওসি ইফতেখারের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলেন, আমার বিরুদ্ধে ছয় মাসে মাত্র ৩০টি তদন্ত হচ্ছে—আমি অনেক ভালো আছি।
ডিএমপির মিডিয়া উইংয়ের ডিসি তালেবুর রহমান বলেন, অভিযোগগুলো তদন্তাধীন।
তেজগাঁও বিভাগের ডিসি ইবনে মিজান বলেন, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।
মোহাম্মদপুর থানায় ওসি আলী ইফতেখার হাসানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ শুধু বিচ্ছিন্ন নয়, বরং এটি একটি বিস্তৃত ও গভীর প্রভাবশালী দুর্নীতির সিন্ডিকেটেরই প্রতিচ্ছবি। মামলা গায়েব, নিরীহদের ফাঁসানো, ভয়ভীতির রাজত্ব, চাঁদাবাজি, মাদক সিন্ডিকেটের পৃষ্ঠপোষকতা এবং সাংবাদিক নির্যাতনের মতো অভিযোগ শুধু ওসির নয়, পুরো প্রশাসনিক কাঠামো ও দায়বদ্ধতা ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
স্থানীয়দের অন্তত ১০টি মানববন্ধন, শতাধিক লিখিত অভিযোগ এবং বহু অনলাইন প্রতিবাদ সত্ত্বেও ওসি ইফতেখার বহাল তবিয়তে থাকায় প্রশ্ন উঠে—পুলিশের জবাবদিহিতা কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে মোহাম্মদপুরের হাজারো মানুষ।
যতদিন না তদন্ত স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয় এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়, ততদিন মোহাম্মদপুর থানার প্রতি জনসাধারণের আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি