যশোরে ১০ কোটি টাকার পশুর হাট দুই কোটিতে ইজারা

ছবি: সংগৃহীত
যশোর জেলার সব থেকে বড় পশুর হাট বাগআঁচড়া সাতমাইলের পশুর হাট। হাটটি প্রতিবছর ৬ কোটি টাকা থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত ইজারা দেয়া হতো। তবে এ পশুর হাটটি সম্প্রতি ২ কোটি ২৫ লাখ টাকায় ইজারা দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় ব্যাপক কানাঘুষা তৈরি হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলার সব থেকে বড় পশুর হাট শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়া সাতমাইল পশুর হাট। এ পশুর হাটটি পতিত শেখ হাসিনা সরকারের আমলেও প্রতিবছরে ইজারা দেয়া হতো ৬ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত। তবে এর আগে এর থেকে বেশি টাকায়ও ইজারা দেওয়া হয়েছে। এ বৃহত্তম এই গরু হাটটি বাংলা ১৪২৯ সালে ইজারা দেয়া হয়েছিল ৬কোটি টাকার অধিক। ১৪৩০ সালে হাটটি ইজারা দেয়া হয় ১০ কোটি ২৫ লাখ টাকায়।
গত বছরের ১৩ এপ্রিল বাগআঁচড়ার সাতমাইল পশুর হাটের ইজারা শেষ হয় । এরপর ১৪ এপ্রিলে সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দীনের নির্দেশে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নয়ন কুমার রাজবংশী বিশেষ ব্যবস্থায় হাটটি চালাতেন বাগআচড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক চেয়ারন্যান ও ক্যাডার খ্যাত ইলিয়াস কবির বকুল ও কায়বা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক চেয়ারম্যান সন্ত্রাসী হাসান ফিরোজ টিংকু । এরা দুজনই সাবেক এমপি 'আফিল উদ্দীনের ডান হাত ছিলো। বকুল চেয়ারম্যান ও শফিকুল ইসলাম ধাবক গ্রুপের মধ্যে হাটের ইজারা পাওয়া নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
বকুল-টিংকুর কাছে থেকে ব্যাপারীরা ৩ হাজার টাকা দিয়ে কার্ড গ্রহণ করলেও গরু প্রতি তাদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে আদায় করা হতো। সাধারণ ক্রেতাদের কাঁছে থেকে গরু প্রতি ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা আদায় করা হতো । অথচ গরুর হাট ইজারা না হওয়ায় সরকারী পাস মূল্য ছিল ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা । আর ছাগল-ভেড়া ছিল ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে হাটটি পরিচালনায় আওয়ামী লীগের ওইসব নেতা গা ঢাকা দিলে ছাত্রজনতাকে সঙ্গে নিয়ে কয়েক হাট পরিচালনা করছিলেন শার্শা উপজেলা প্রশাসন । কিন্তু আওয়ামী-লীগের ইউনিয়ন সভাপতি বকুল ও টিংকুর কাছ থেকে করা ব্যাপারী কার্ডের কেনো সুবিধা পায়নি সাধারণ ব্যবসায়ী কার্ডধারীরা। হাটে কার্ডধারী ব্যাপারী ও সাধারণ ক্রেতাদের একই মূল্যে প্রতিটি গরুর পাস শুরু হলে ক্ষুব্ধ হয় কার্ডধারী ব্যাপারীরা । তারা আন্দোলন শুরু করলে আইনশৃঙ্খলা অবনতির শঙ্কায় গত ২০ আগস্ট হাটটি বন্ধ করে দেয় উপজেলা প্রশাসন । এর পরের বছর হাটটি ইজারা বন্ধ হয়ে যায়। এর পর থেকে উপজেলা প্রশাসন হাটটি নিয়ন্ত্রণ করে খাস আদায় করেন। ওই বছরে দুই কোটি ৮৮ লাখ টাকা খাস আদায় করেন। উপজেলা প্রশাসন এক বছরে এত কম পরিমানে খাস আদায় নিয়ে এলাকায় বিতর্ক তৈরি হয়।
মোহাম্মদপুর ওসির অপসারণ রোধে মাদকচক্র ও কিশোর গ্যাংয়ের মানববন্ধন
আবার গত ২৭শে সেপ্টেম্বর ফের চালু হয় পশুর হাটটি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর হাটের অলিখিত দায়িত্ব পান বাগআচড়া ইউনিয়ন বিএনপির যুগ আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর গরু প্রতি খাস আদায় হতো প্রায় ৫০ লাখ টাকা। অথচ উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তিন লাখ টাকা দেখতো উপজেলা প্রশাসনের কোষাগারে। বাকি টাকা স্থানীয় কয়েকজন নেতা ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করা হতো। আবার কিছু ভাগ রাখা হতো উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হওয়ায় সাংবাদিকরা খোঁজখবর নেয়া শুরু করেন। একপর্যায়ে উপজেলা প্রশাসন গত বুধবারে তড়িঘড়ি করে কথিত টেন্ডারের মাধ্যমে প্রতি হাট ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা মূল্যে অর্থাৎ বছরে ২ কোটি ৪১ লাখ টাকা ইজারা দেন স্থানীয় বিএনপি নেতা ও ব্যবসায়ীর কাছে। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্যকর তৈরি হয়েছে।
বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থীদের দুর্বার আন্দোলনে ৫ই আগস্টে তৎকালীন স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এর পর পর স্থানীয় কয়েকজন বিএনপি'র নেতা প্রভাব খাটিয়ে পশুরহাটটি নিয়ন্ত্রণে নেন। তাদের সঙ্গে গা ভাসিয়ে দেন উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও। কয়েকজন নেতা ও সরকারি কর্মকর্তারা মিলেমিশে পশুর হাটের খাস আদায় করেন। প্রতিহাটে প্রায় পঞ্চাশ লাখ টাকা খাস আদায় করতেন। এসব টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নাম সর্বস্ব ৩ লাখ টাকা উপজেলা প্রশাসনের কোষাগরে জমা দেন।বিষয়টি জানাজানি হলে স্থানীয়দের মধ্যে চাপা ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সমালোচনা ও অনিয়ম ঢাকতে উপজেলা প্রশাসন ও এসব নেতারা কৌশলে ওপেন টেন্ডারের আয়োজন করেন। নিজেরাই আবার কৌশলে নামমাত্র মূল্যে পশু হাটের ইজারা নেন এ নেতারা।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে হাটের কয়েকজন জানান, ৫ই আগস্টের পর স্বঘোষিত হাট মালিক আলোচিত জাহাঙ্গীর গং তারা বিকরগাছা উপজেলার শংকরপুর এলাকার সেলিম হোসেন কে দিয়ে শার্শা উপজেলা নির্বহী কর্মকর্তাকে হাটের পরিচালনার বিজ্ঞাপন তৈরি করে বিভিন্ন পত্রিকায় সরবরাহ করেন। “হাট পরিচালনা এবং প্রচার হলে জেলার শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা”-লেখা বিজ্ঞাপন অন্য উপজেলা একটি ইউনিয়ন থেকে পাঠানোর কারণে বিষয়টি নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। প্রথমে বলা হয় বিজ্ঞাপনটি প্রকাশ করলে ৩ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। পরে দাম তোলে ১০ হাজার টাকা । পরে শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. কাজী নাজিব হাসান জানান, “বিজ্ঞাপনটি তার নয়।
পরে তিনি জানিয়েছিলেন, বিজ্ঞাপনটি যশোরের শার্শার বাগআঁচড়া সাতমাইল পশুর হাটের হাট আদায়কারী জাহাঙ্গীর হোসেনের। ওই সমযয়ে তিনি বিষয়টি ভুল ও স্বীকার করেছিলেন। পরে আবার “হাট পরিচালনা এবং প্রচারে যশোর শার্শা উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা”-লেখা বিজ্ঞাপন কয়েকটি কাগজে পাঠানো বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এ সময়ে হাট থেকে তথ্য ৪০ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা আদায় হলেও উপজেলা প্রশাসনকে মাত্র তিন লাখ টাকা বুকিং দিতেন। বিষয়টা সাংবাদিকরা খোঁজখবর নেয়ার সাথে সাথে অবৈধ কারবার বৈধ করতে তড়িঘড়ি করে উপজেলা প্রশাসন নাম সর্বস্ব টেন্ডার দেন। যে টেন্ডার বিএনপি নেতা হাসান জহিরের ঘনিষ্ঠ তিন সাগরেত টেন্ডার দাখিল করে এবং নামমাত্র মূল্যে পশুহাটা ইজারা নেন।
বিষয়টি নিয়ে শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. কাজী নাজিব হাসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জামতলা পশুর হাট থেকে খাস আদায় করা অনেক কঠিন। আমি আসার আগে আমার অফিসের লোকজন যারা খাস আদায় করত তাদেরকে মার-ধোর আটকে রাখা হয়েছিল। তাই স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে খাস আদায় করা হতো। প্রতি হাটে তিন লাখ টাকা মতো জমা হতো। তবে গত বুধবারে ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে প্রতি হাটে তিন লাখ একত্রিশ হাজার টাকা মূল্যে একজন ব্যবসায়ীকে ইজারা দেয়া হয়েছে। সেই অনুপাতে বছরে দুই কোটি ৪০ লাখ টাকার মত আসে। ১০ কোটি টাকার পশুর হাট দুই কোটিতে ইজারার কারণ জানতে চাইলে তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ওপেন টেন্ডারে মাধ্যমে এই টাকা উঠেছে। তাই এই টাকায় পশুর হাটটি ইজারা দেয়া হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে বাগআচড়া ইউনিয়ন বিএনপির যুগ আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত বেশ কয়েক মাস ধরে আমাদের লোকজনও উপজেলা প্রশাসনের লোকজন মিলে গরু হাটের খাজনা আদায় করে আসছিল। তবে গত দুই দিন আগে বাবু নামে একজনের নামে ইজরা হয়েছে। আমরা বসাবসি করে পশুর হাটের খাজনা আদায়ের বিষয়টি নির্ধারণ করবো।
বিষয়টি নিয়ে যশোরের জেলা প্রশাসক মোঃ আজহারুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি ' বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তবে খোঁজখবর নেব। পশুর হাট ইজারা নিয়ে কোন ধরনের কারসাজি বা অনিয়ম থাকলে পশুর হাটের ইজারা বাতিল করে পুনরায় ইজারার জন্য টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এনডি