News Bangladesh

পরিতোষ লিমন, সাংবাদিক || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৩:১০, ১০ আগস্ট ২০২৫
আপডেট: ১৪:৫৭, ১০ আগস্ট ২০২৫

জলবায়ু সংকটে ‘নিরীহ’ থেকে ‘নিষ্ঠুর’ হয়ে উঠছে কাঠবিড়ালি

জলবায়ু সংকটে ‘নিরীহ’ থেকে ‘নিষ্ঠুর’ হয়ে উঠছে কাঠবিড়ালি

ছবি: সংগৃহীত

আমাদের পরিচিত কাঠবিড়ালি—যাদের আমরা এতদিন ধরে ফল-মূল, বীজ, পোকামাকড় খাওয়া নিরীহ প্রাণী হিসেবে চিনি, সেই কাঠবিড়ালির মধ্যেই ঘটছে আচরণগত এক চমকপ্রদ বিবর্তন। 

সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ডেভিসের ১২ বছরের গভীর গবেষণা থেকে জানা গেছে, ক্যালিফোর্নিয়া গ্রাউন্ড স্কুইরেল (Otospermophilus beecheyi) এখন ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী ভোলকে (vole) সক্রিয়ভাবে শিকার করছে। 

শুধু শিকারই নয়, শিকারী হিসেবে নিজেদের অধিকারের জন্য কাঠবিড়ালিরা একে অপরের সঙ্গেও আক্রমণাত্মক হচ্ছে।

এই তথ্যগুলো প্রাণিবিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের জন্য একেবারে নতুন এক ধাঁধা, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যহীনতার দিকেই ইঙ্গিত করে।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, ডেভিস-এর গবেষকরা প্রথমবারের মতো প্রামাণ্য চিত্রে ধারণ করেছেন—ক্যালিফোর্নিয়া গ্রাউন্ড স্কুইরেল (Otospermophilus beecheyi) একটি ভোল (vole) নামক ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীকে সক্রিয়ভাবে তাড়া করে হত্যা করছে এবং খেয়েও নিচ্ছে।

‎এই পর্যবেক্ষণ শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—১২ বছরের দীর্ঘ ফিল্ড স্টাডি ও ক্যামেরা ট্র্যাপ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কিছু কাঠবিড়ালি শুধু ভোল শিকার করছে না, বরং শিকারের অধিকারের জন্য একে অপরের সঙ্গে আক্রমণাত্মক আচরণ করছে। এমন হিংস্র শিকারি প্রবণতা আগে কাঠবিড়ালির মধ্যে প্রায় কখনোই দেখা যায়নি।

জার্নাল অব ইথোলজিতে “Vole hunting: novel predatory and carnivorous behavior by California ground squirrels” ‍শিরোনামের এক ‎গবেষণাপত্রে প্রধান লেখক অধ্যাপক জুলি ই. স্মিথ ও তার সহকর্মীরা উল্লেখ করেন, এই আচরণ কাঠবিড়ালির ঐতিহ্যবাহী খাদ্যচক্রের পরিপন্থী। এটি সম্ভবত পরিবেশগত চাপে অভিযোজনের বহিঃপ্রকাশ।

‎গবেষকরা জানান, ভোল জনসংখ্যার আকস্মিক বিস্ফোরণ এবং প্রোটিনের সহজলভ্য উৎস হিসেবে এদের প্রাপ্যতা কাঠবিড়ালিকে “আচরণগত গৃহপালিততা” থেকে হঠাৎ করে “শিকারি অভিযোজন”-এর দিকে ঠেলে দিয়েছে।

‎ক্যালিফোর্নিয়ার কিছু অংশে অব্যাহত খরা, খাদ্যপ্রবাহে পরিবর্তন ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যহীনতা এমন আচরণগত পরিবর্তনের পেছনে ভূমিকা রাখছে বলে ধারণা করছেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা। 

‎জলবায়ু গবেষক ড. লেসলি কার্টার বলেন, এটি একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত—সাধারণত নিরীহ হিসেবে পরিচিত প্রাণীর মধ্যেও শিকারি প্রবণতা জেগে উঠতে পারে যদি বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য বিঘ্ন ঘটে।

‎ক্যালিফোর্নিয়া গ্রাউন্ড স্কুইরেল বরাবরই পরিচিত ছিল ফল, শস্য, বীজ ও কখনো কখনো পোকামাকড় খাওয়ার জন্য। কিন্তু এভাবে স্তন্যপায়ী প্রাণী শিকার করে খাওয়ার প্রমাণ বিজ্ঞানীদেরও চমকে দিয়েছে।

‎এই প্রথম নয় যে, নিরীহ প্রাণীদের মধ্যে আচরণগত রূপান্তর দেখা যাচ্ছে। 

  • ‎অস্ট্রেলিয়ার কিছু ক্যাঙ্গারু প্রজাতি হালকা মাংসাশী আচরণ দেখিয়েছে খরা চলাকালীন। 
  • ‎আফ্রিকার কিছু বানরগোষ্ঠী—খাদ্যাভাবে ছানাদের ফেলে রেখে খাদ্য সংগ্রহে অতিরিক্ত হিংস্র আচরণ করেছে। 
  • ‎এমনকি পেঙ্গুইনদের মধ্যেও হিংস্র যৌনাচরণ ও শিকারি আচরণ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে পরিবেশগত চাপের সময়। 

‎এই সবই ইঙ্গিত দেয়, আধুনিক পৃথিবীতে পরিবেশগত চাপে প্রাণীরা আর 'নিরীহ' থেকে যাচ্ছে না—তারা বদলাচ্ছে, দ্রুত।

‎গবেষক দল স্বয়ংক্রিয় ইনফ্রারেড ক্যামেরা ট্র্যাপের মাধ্যমে ৫৪টি আলাদা শিকারের চিত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। 

একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি প্রাপ্তবয়স্ক মাদি কাঠবিড়ালি একটি ভোলকে পেছন থেকে ধাওয়া করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কণ্ঠনালী কামড়ে ধরে, তারপর মাটিতে আছড়ে ফেলে মৃত্যু নিশ্চিত করে—এবং তাৎক্ষণিকভাবে খেতে শুরু করে। 

‎এরকম দৃশ্য আগে কখনো বিজ্ঞানীরা কাঠবিড়ালির ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করেননি। 

‎বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না এটি সাময়িক অভিযোজন, না কি স্থায়ী পরিবর্তনের শুরু। তবে, এই আচরণ যদি বংশানুক্রমিকভাবে সংরক্ষিত হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কাঠবিড়ালি প্রজাতির মধ্যে শিকারি বৈশিষ্ট্য ছড়িয়ে পড়তে পারে। 

‎এই ঘটনার গুরুত্ব শুধুই প্রাণিবিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি সরাসরি ইঙ্গিত দেয়—জলবায়ু পরিবর্তন, বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্যহানি এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হলে প্রাণীরা দ্রুত রূপান্তর ঘটাতে বাধ্য হয়। আর এই রূপান্তর, অনেক সময় সরাসরি বিপজ্জনক হতে পারে মানুষের সহাবস্থানের দিক থেকেও। 

‎উদাহরণস্বরূপ, যদি শহরাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে ইঁদুর বা ছোট প্রাণী দেখা দেয় এবং একই সঙ্গে কাঠবিড়ালির মতো প্রাণীরা হিংস্র অভিযোজন দেখাতে শুরু করে—তাহলে শহুরে ইকোসিস্টেমেও নতুন চাপ সৃষ্টি হতে পারে।

‎আজকের এই গবেষণা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতি কখনো স্থির নয়। আমরা যাদের “নিরীহ”, “নির্দোষ”, “নির্বিষ” বলে জানতাম, তারাও সময় ও চাপে বদলে যেতে পারে—শিকারিতে পরিণত হতে পারে।

‎এটি শুধু কাঠবিড়ালির গল্প নয়। এটি মানবসভ্যতার জন্য একটি সতর্কবার্তা—প্রকৃতির ওপর প্রতিনিয়ত চাপ সৃষ্টি করে আমরা তার অভ্যন্তরীণ গঠনে কী গভীর পরিবর্তন আনছি, তার প্রমাণ এই ঘটনাই।

নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়