চট্টগ্রামে সেতু ধস ও জলাবদ্ধতায় অচল নগর

ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম মহানগরীর বায়েজিদ বোস্তামী সড়কের স্টারশিপ গলির শীতলঝরনা খালের ওপর নির্মিত একটি সেতুর একটি অংশ বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) সকাল ছয়টার দিকে হঠাৎ ধসে পড়ে। যার ফলে নগরের অন্যতম ব্যস্ত করিডোর “২ নম্বর গেট–অক্সিজেন” সড়কে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ যানজট।
ঘটনার পর থেকে পুরো নগরে ছড়িয়ে পড়ে যান চলাচলের মারাত্মক বিঘ্ন, জলাবদ্ধতা ও নাগরিক দুর্ভোগের এক চিত্র।
স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল থেকেই সেতুর ধসে পড়া অংশের কারণে যান চলাচল থমকে যায়। দুই নম্বর গেট থেকে অক্সিজেনমুখী লেন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়ায় উভয় দিকের যানবাহনকে বিপরীত লেনে সীমিতভাবে চলাচল করতে হচ্ছে। এতে সড়কে তৈরি হয় দীর্ঘ যানজট। অফিস টাইমে জনস্রোত ও যানবাহনের চাপের ফলে দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের জানান, এই ব্রিজটি প্রায় ৬৫ বছরের পুরনো। আমরা এটিকে ৬০ ফিট প্রশস্ত করে পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনা করেছি। জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান খাল সংস্কার প্রকল্পের কারণে আশপাশের মাটি সরে গিয়ে ফাটল দেখা দিয়েছিল। একই রকম ঘটনা মহেশখালাতেও ঘটেছে।
তিনি আরও বলেন, বিকল্প পথ নিশ্চিত করে আপৎকালীন যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দ্রুত ব্রিজ সংস্কারে প্রকৌশলীরা কাজ শুরু করবেন।
চসিক সূত্র জানায়, সেতুটিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে আগেই চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং ইতোমধ্যে প্রায় ৫ কোটি টাকার প্রাক্কলন করে দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছিল।
প্রধান প্রকৌশলী আনিসুর রহমান জানান, ১৯৮০ সালের দিকে ইট দিয়ে নির্মিত এই সেতু দীর্ঘদিন ধরেই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় খাল প্রশস্ত হওয়ার ফলে পানির প্রবাহ বেড়ে যায়, যার কারণে সেতুর পাশের মাটি সরে গিয়ে ধস দেখা দেয়। বৃহস্পতিবার ভোরের টানা ভারী বৃষ্টিতে চূড়ান্তভাবে সেতুটি ভেঙে পড়ে।
বায়েজিদ বোস্তামী থানার উপ-পরিদর্শক শামসুল ইসলাম জানান, ভেঙে যাওয়া অংশের পাশের দিকটিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ওই পাশও যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে। তাই সীমিত যান চলাচলের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে।
সেতু ধসের পাশাপাশি নগরীর বিভিন্ন এলাকায় রাত থেকে টানা বৃষ্টিতে দেখা দিয়েছে মারাত্মক জলাবদ্ধতা। সকাল ৯টা পর্যন্ত চব্বিশ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ৮১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস। শুধু সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় রেকর্ড হয়েছে ২৪ মিলিমিটার বৃষ্টি।
জলাবদ্ধতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আগ্রাবাদ, কাতালগঞ্জ, চকবাজার, এনায়েত বাজার, ওয়াসা মোড়, রাহাত্তারপুল, জিইসি, মুরাদপুর, আমবাগান ও স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকা। এসব এলাকায় সড়ক ও বাসাবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। অফিসগামী ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য দুর্ভোগ ছিল চরমে।
আরও পড়ুন: কাঁটাবনে পিকআপ-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২
রাহাত্তারপুল এলাকার বাসিন্দা মামুনুল হল বলেন, রাত থেকে টানা বৃষ্টিতে রাস্তা তলিয়ে গেছে। অনেকেই জুতা হাতে নিয়ে হেঁটে অফিসে যাচ্ছেন। গাড়িও পাওয়া যাচ্ছে না, আর পেলেও ভাড়া দ্বিগুণ আদায় করছে।
জলাবদ্ধতার কারণে অনেক রুটে গণপরিবহন সংকট দেখা দিয়েছে। রিকশা ও সিএনজি চালকরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন বলে অভিযোগ করেছেন নগরবাসী।
বৃহস্পতিবার ভোরে অক্সিজেন-মুরাদপুর সড়কে একটি কালভার্ট পানির স্রোতে ধসে পড়ে। ফলে এই সড়ক দিয়ে যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। নগরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছানোর এই গুরুত্বপূর্ণ করিডোরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় ভোগান্তি বেড়েছে বহুগুণ।
চট্টগ্রাম নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), চসিক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় বর্তমানে ১৪ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকার চারটি মেগা প্রকল্পে জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ চলছে। এর মধ্যে বহদ্দারহাট ও মুরাদপুর এলাকায় জলাবদ্ধতা না হওয়ায় স্থানীয়রা কিছুটা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই এলাকাগুলোতে প্রকল্পের সুফল মিলছে।
তবে নগরবাসীর অভিযোগ, নালা-নর্দমা ও খালে জমে থাকা আবর্জনা ও অপরিকল্পিত খাল খননের কারণে পানি চলাচলের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে স্রোতের দিক পরিবর্তন হয়ে কিছু এলাকায় দুর্বল মাটি ধসে গিয়ে বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করছে।
স্টারশিপ গলির ধসে পড়া সেতু সংলগ্ন এলাকায় ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, পোশাক কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ছোট-বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিদিন হাজারো শ্রমিক, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ এই পথ দিয়ে যাতায়াত করেন। সড়ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত হয়েছে। দুর্ভোগ কমাতে দ্রুত সেতু পুনর্নির্মাণের দাবি জানাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ জানিয়েছে, নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পাশাপাশি জনসাধারণকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অক্সিজেন–২ নম্বর গেট সড়ক এড়িয়ে চলার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি