News Bangladesh

নিউজ ডেস্ক || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১২:০৬, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের জন্য বিদেশি ঋণসীমা বেঁধে দিল আইএমএফ

বাংলাদেশের জন্য বিদেশি ঋণসীমা বেঁধে দিল আইএমএফ

ছবি: সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের ওপর বিদেশি ঋণ গ্রহণের ওপর সরাসরি সীমা আরোপ করেছে। 

সংস্থার শর্ত অনুযায়ী, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ৮৪৪ কোটি ডলার ঋণ নিতে পারবে।

গত জুনে ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১৩৪ কোটি ডলার ছাড়ের পর প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপোর্ট’-এ পরবর্তী কিস্তি পেতে যে শর্তগুলো মানতে হবে, তার মধ্যে এই সীমা অন্যতম। শর্ত অনুযায়ী, ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ঋণের পরিমাণও নির্ধারণ করা হয়েছে—প্রথম তিন মাসে সর্বোচ্চ ১৯১ কোটি, ছয় মাসে ৩৩৪ কোটি, নয় মাসে ৪৩৪ কোটি এবং পুরো অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৮৪৪ কোটি ডলার। প্রতি তিন মাস অন্তর বিদেশি ঋণের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবে আইএমএফ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আইএমএফের সর্বশেষ ঋণ স্থায়িত্ব বিশ্লেষণ (ডিএসএ) অনুযায়ী এই সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই বিশ্লেষণে বাংলাদেশকে ধারাবাহিকভাবে দুই অর্থবছর ধরে ‘মধ্যম ঝুঁকি’র দেশ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। আগে ‘কম ঝুঁকি’ বিবেচনায় থাকলেও রপ্তানি ও রাজস্ব আয়ের তুলনায় ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়ে যাওয়ায় ঝুঁকির মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ডিএসএ অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঋণ-রপ্তানি অনুপাত ১৬২.৭ শতাংশে পৌঁছেছে, যা প্রাক্কলিত ১১৬-১১৮ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। বিদেশি ঋণ-রাজস্ব অনুপাতও বেড়েছে। ফলে নতুন ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা সীমিত হয়েছে।

আইএমএফ ২০২৩ সালে বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করলেও তখন এমন কোনো শর্ত ছিল না। তবে চলতি বছরের জুনে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি অনুমোদনের সময় মূল ঋণের পরিমাণ ৮০০ মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পায় এবং মেয়াদও ছয় মাস বাড়ানো হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ এই প্রোগ্রাম থেকে ৩.৬ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার ৮৫৭ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ নিয়েছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ঋণ নেওয়া হয়েছে ২০ কোটি ২৪ লাখ ডলার। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় এবার কিছুটা কম ঋণ নিতে হবে।

আরও পড়ুন: রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে উৎসাহ বোনাসে নতুন নিয়ম

সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল ও অর্থ সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতে বিদেশি ঋণ পরিশোধের বোঝা অনেক বেড়েছে। যেহেতু ঋণ বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হচ্ছে, তাই ঋণ-জিডিপি অনুপাতের পাশাপাশি রাজস্ব ও রপ্তানির বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবতার ভিত্তিতে আইএমএফ হয়তো এই শর্ত দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা এই পদক্ষেপকে সতর্ক সংকেত হিসেবে দেখছেন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, আইএমএফ আগে বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে আশাবাদী ছিলেন, কিন্তু এখন বৈদেশিক মুদ্রা ঘাটতি ও রিজার্ভ সংকটের কারণে আগের উদাসীনতা আর নেই। ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়ে গেছে।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আর্থিক শৃঙ্খলার দুর্বলতার কারণে আইএমএফ এই কড়াকড়ি আরোপ করেছে। ঋণ নিতে হলে ডলারেই পরিশোধ করতে হবে, তাই রাজস্ব ও রপ্তানি আয়ের হিসাব গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণের ধারাবাহিক বৃদ্ধি নতুন নয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ ছিল ২০.৩ বিলিয়ন ডলার, ২০২৩-২৪ এ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮.৮ বিলিয়ন ডলারে, আর ২০২৫ সালের জুনে ঋণের পরিমাণ ৮০.১৯ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। এ ঋণের বড় অংশ এসেছে মেগা প্রকল্প ও করোনাজনিত ব্যয় থেকে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৩ বছরে বাংলাদেশের সরকারি ও সরকারি-গ্যারান্টিযুক্ত ঋণ তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে—যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্রুততম ঋণ বৃদ্ধির রেকর্ড।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, এত বেশি উদ্বেগের কিছু নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নতুন ঋণ নেওয়ার প্রবণতা আগের বছরের তুলনায় কম। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নতুন ঋণ হয়েছে ৮.৩২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরের জুলাই ও আগস্ট মিলিয়ে সই হয়েছে মাত্র ২৩৪ মিলিয়ন ডলারের ঋণ—আইএমএফের নির্ধারিত সীমার তুলনায় নগণ্য।

তবে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে “নন-কনসেশনাল” বা অনমনীয় শর্তের ঋণ। ২৪ সেপ্টেম্বর ইআরডি’র এসসিএনসিএল কমিটির বৈঠকে একসঙ্গে অনুমোদন পেয়েছে ১.৪৭ বিলিয়ন ডলারের ৭টি ঋণ প্রস্তাব, যার মধ্যে আছে—এডিবি থেকে ৬৪৯ মিলিয়ন ডলার, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ২৪১.৩ মিলিয়ন ডলার, এআইআইবি থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা, এবং ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক থেকে দুটি পানি প্রকল্পে ১৬০ মিলিয়ন ইউরো। এসব ঋণের বাজারভিত্তিক শর্ত প্রায় ২৫ শতাংশ গ্রান্ট কমিয়ে দিয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় কাজ হলো ঋণনির্ভরতা কমানো। রাজস্ব আহরণ বাড়ানো, রফতানির বৈচিত্র্য নিশ্চিত করা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ টানার মাধ্যমে অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করানো ছাড়া বিকল্প নেই।

আইএমএফের শর্ত তাই কেবল একটি সীমা নয়, বরং বাংলাদেশের জন্য বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার বার্তা। গত দেড় দশকের ঋণ-নির্ভর উন্নয়ন এখন নতুন চাপ তৈরি করছে। ভবিষ্যতে সরকার যদি নিজস্ব আয় বাড়াতে না পারে, তবে বিদেশি ঋণ হয়তো আর ভরসার জায়গা হবে না—বরং অর্থনীতির জন্য নতুন সংকটের উৎস হয়ে উঠতে পারে।

নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়