জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা

ছবি: সংগৃহীত
‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক দীর্ঘ ভাষণে আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি, অর্থনৈতিক অবস্থা, সমুদ্রসম্পদ ব্যবস্থাপনা, প্রবাসনীতি ও বিদেশে কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে বিস্তারিত ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) রাত ৮টা ২০ মিনিটে জাতির উদ্দেশ্যে সম্প্রচারিত হয় ভাষণটি।
ভাষণের শুরুতেই প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে চিঠি পাঠানো হবে, যাতে রমজান শুরু হওয়ার আগে নির্বাচন সম্পন্ন করা যায়।
তিনি বলেন, এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা—নির্বাচন অনুষ্ঠান। আজ এই মহান দিবসে বক্তব্য দেওয়ার পর থেকেই আমরা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করব—নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া।
তিনি দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়ে বলেন, নির্বাচন যেন শান্তিপূর্ণ, উৎসবমুখর এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ হয়, সেই লক্ষ্যে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করব।
তিনি আরও বলেন, আমরা চাই এবারের নির্বাচন আনন্দ-উৎসবের দিক থেকে, শান্তি-শৃঙ্খলার দিক থেকে, ভোটার উপস্থিতির দিক থেকে দেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকুক। আগামীকাল থেকেই এ লক্ষ্যে মানসিক প্রস্তুতি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হবে বলে তিনি জানান।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত ১৫ বছর ধরে দেশের মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। এবারের নির্বাচন হবে বকেয়া আনন্দসহ মহা-আনন্দে ভোট দেওয়ার উৎসব। যারা জীবনে প্রথমবার ভোট দেবেন, তারা যেন উৎসবের মাধ্যমে এই স্মরণীয় দিনটি উদযাপন করতে পারেন।
তিনি নারী ভোটারদের অংশগ্রহণ উৎসাহিত করতে বিশেষ পদক্ষেপের কথাও জানান।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিচ্ছে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অবদানের কারণে আজ বিধ্বস্ত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে।
তিনি জানান, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ভঙ্গুর অর্থনীতি ও ভয়াবহ বন্যার কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ শতাংশে উঠেছিল। এখন তা কমে অর্ধেকে এসেছে। আমরা আশা করছি ডিসেম্বরের মধ্যে তা ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।
তিনি আরও জানান, জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৮.৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত ৩৫ মাসে সর্বনিম্ন। গত চার মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে মূল্যস্ফীতি কমছে।
প্রবাসীদের আস্থা ও সরকারের সুশাসনের কারণে গত অর্থবছরে রেকর্ড ৩,০৩৩ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়েছে। রপ্তানিতেও প্রায় ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে তিনি জানান।
আরও পড়ুন: স্বৈরাচার পতনের বর্ষপূর্তিতে জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ
বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, গত ১১ মাসে বিদেশি পাওনাদারদের ৪ বিলিয়ন ডলার সুদ ও আসল পরিশোধ করা হয়েছে। এর পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা আরও জানান, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ১০,৫০০ কোটি টাকা ও ছয় মাসে ১৬,৫০০ কোটি টাকা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, যা আগের সরকারের তুলনায় দ্বিগুণ।
বিশেষভাবে তিনি বলেন, হংকংভিত্তিক হানডা কোম্পানি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে ২৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার মাধ্যমে ২৫,০০০ নতুন কর্মসংস্থান হবে। এটি চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা বলে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত ১৬ বছরে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে, তা ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক আইনজীবী প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় কার্যক্রম শুরু করেছি। ইতোমধ্যে কিছু অবৈধ সম্পদ জব্দ হয়েছে।
ড. ইউনূস বলেন, আমরা প্রায়ই ভুলে যাই, বঙ্গোপসাগরের বিশাল অংশ আমাদের দেশের অঙ্গ। এই পানিভাগ আমাদের জমির থেকেও বড়।
তিনি জানান, এখন থেকে পানিভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে।
তিনি বলেন, সমুদ্র থেকে মৎস্য ও গ্যাস আহরণের মাধ্যমে শিল্প গড়ে তুলব, যাতে লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থান হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নৌবাহিনীর অধীনে ড্রাই ডক লিমিটেডকে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দেওয়ার পর প্রতিদিন গড়ে ২২৫টি কনটেইনার বেশি হ্যান্ডলিং হচ্ছে।
তিনি কুমিরা থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্রসীমান্তজুড়ে নতুন শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথাও জানান এবং বলেন, এটি দক্ষিণ এশিয়ার একটি নতুন অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হবে।
প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করেন, আগামী পাঁচ বছরে জাপানে অন্তত ১ লাখ বাংলাদেশি তরুণকে পাঠানোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। পাশাপাশি ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া, সার্বিয়া ও অন্যান্য দেশে কর্মী পাঠানোর ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।
ভিসা জটিলতা দূর করার কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, আরব আমিরাত পুনরায় ভিসা চালু করেছে, মালয়েশিয়া মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা দিয়েছে। ই-রেগুলার প্রবাসীদের বৈধতা ফিরিয়ে আনতে দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে।
তিনি জানান, এই বছর ৮৭ হাজার বাংলাদেশি হজ পালনে সক্ষম হয়েছেন এবং ব্যয় তুলনামূলকভাবে কম ছিল। ‘লাব্বাইক’ নামে চালু হওয়া অ্যাপের মাধ্যমে হাজিদের আত্মীয়রা তাৎক্ষণিকভাবে অবস্থান জানতে পেরেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের হজ ব্যবস্থাপনা প্রশংসিত হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ভাষণের শেষ অংশে প্রধান উপদেষ্টা দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান, নতুন বাংলাদেশ গঠনের ভিত্তি রচনা হবে এবারের নির্বাচনে। তাই সবাই প্রস্তুতি নিন, আলোচনা করুন, পরিকল্পনা করুন—এবারের ভোট হোক আমাদের জাতীয় উৎসব, আমাদের নাগরিক অধিকার পুনরুদ্ধারের আনন্দ-উৎসব।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি