স্বৈরাচার পতনের বর্ষপূর্তিতে জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ

ছবি: সংগৃহীত
স্বৈরাচারী শাসনের পতনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) রাত ৮টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিটিভি নিউজ, বাংলাদেশ বেতার ও একাধিক বেসরকারি টিভি চ্যানেলে একযোগে প্রচারিত এ ভাষণে তিনি গত এক বছরের অর্জন, অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রগতি এবং আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিস্তারিত বক্তব্য রাখেন।
ভাষণের শুরুতেই অধ্যাপক ইউনূস ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের স্মরণীয় মুহূর্তকে স্মরণ করেন, যেদিন ‘স্বৈরাচারী সরকারের পতন ও প্রধানমন্ত্রীর পলায়ন’ ঘটে। তিনি একে ‘গণজাগরণ ও জনগণের বিজয়ের দিন’ হিসেবে বর্ণনা করেন এবং বলেন, এই দিনটি কেবল অতীতের পাতা নয়, এটি ভবিষ্যতের পাথেয়। আমরা যা হারিয়েছি, তার চেয়েও বড় কিছু ফিরে পেয়েছি—আত্মবিশ্বাস, জনগণের ইচ্ছাশক্তি এবং একটি নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত।
তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক বিকাশ, মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এ সরকার কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং দেশের পুনর্গঠনের ‘জনগণের প্ল্যাটফর্ম’।
এর আগে বিকেল ৫টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি’ উপলক্ষে সরকার ঘোষিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন প্রধান উপদেষ্টা। উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা, ছাত্র ও শ্রম আন্দোলনের প্রতিনিধিগণ এবং শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান ছিল “জাতিগত মুক্তি এবং অসাংবিধানিক শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটানোর একটি ঐতিহাসিক বাঁক।” ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত হয় বিচারব্যবস্থার সংস্কার, নির্বাচন ব্যবস্থার নিরপেক্ষীকরণ এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি।
আরও পড়ুন: ড. ইউনূসের কণ্ঠে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ
একই দিনে দুপুরে যমুনা সরকারি বাসভবনে প্রধানমন্ত্রী একটি স্মারক ডাকটিকিট, উদ্বোধনী খাম ও বিশেষ সিলমোহর উন্মোচন করেন। এটি ‘জুলাই বিপ্লব ও শহীদ স্মৃতি’ বিষয়ক সরকার-প্রণীত ডাক পরিষেবা উদ্যোগের অংশ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা সি. আর. আবরার, শ্রম উপদেষ্টা ডা. দিলীপ কুমার রায় এবং নাগরিক প্রতিনিধি সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
রাতের ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি কেবল স্লোগানে নয়, তা রাষ্ট্রের কাঠামো ও মননে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমরা স্বপ্ন দেখিনি একটি দলীয় শাসনের বদলে আরেকটি কর্তৃত্ববাদী শক্তি প্রতিষ্ঠার, বরং আমরা স্বপ্ন দেখেছি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে পরিচালিত এক নতুন রাষ্ট্রের।
তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত ৩৬টি কমিশন গঠন করেছে—যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগীয় স্বায়ত্তশাসন কমিশন, নির্বাচনী সংস্কার পরিষদ এবং গণমাধ্যম সুরক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি।
ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস জানান, আগত জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের প্রস্তুতির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য, ২০২৬ সালের এপ্রিলের মধ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ নির্বাচন আয়োজন।
তবে তিনি বলেন, আমরা কারও ওপর সময় চাপিয়ে দিচ্ছি না। জাতীয় সহমত, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তবেই নির্বাচন হবে।
ভাষণে তিনি বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বাম জোট, নতুন প্রজন্মভিত্তিক দলসমূহ এবং নাগরিক সমাজের প্রতি আহ্বান জানান যাতে তারা দলীয় প্রতিযোগিতা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সহমতের ভিত্তিতে ভবিষ্যতের রূপরেখা নির্ধারণে অংশ নেয়।
তিনি বলেন, এই অন্তর্বর্তী সরকার কারও প্রতিপক্ষ নয়, এটি একটি ট্রানজিশনাল ট্রাস্ট।
জাতির উদ্দেশে ভাষণের এক ঘণ্টার মধ্যেই জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাস থেকে বিবৃতি আসে, যেখানে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার প্রশংসা করা হয়।
ইউএনডিপি এক বিবৃতিতে জানায়, বছর পূর্তিতে এই ভাষণ গণতান্ত্রিক বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক।
এক বছর আগে এই দিনে, একটি যুগসন্ধিক্ষণ রচিত হয়েছিল; আর আজ, সেই অর্জনের পথচলায় জাতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা হলো। অধ্যাপক ইউনূসের ভাষণ তাই কেবল স্মরণ নয়, বরং একটি বাস্তবভিত্তিক রূপরেখা, যেখানে পুনর্গঠনের গভীর দায়বদ্ধতা ও ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি