‘৫ আগস্ট: জাতির পুনর্জন্মের দিন’

ছবি: সংগৃহীত
‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণতান্ত্রিক, মানবিক ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের দৃপ্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ৫ আগস্ট শুধু একটি তারিখ নয়, এটি একটি প্রতিজ্ঞা, এটি আমাদের গণজাগরণের উপাখ্যান, এটি ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে জাতির পুনর্জন্মের দিন।
মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) সকাল ১০টায় ঢাকাসহ দেশের সব জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত ভার্চুয়াল এ অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, গণআন্দোলনের কর্মী এবং স্বাধীন পেশাজীবীরা যুক্ত হন। একইসঙ্গে জাতীয় সম্প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিত হয় প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য।
ড. ইউনূস বলেন, ২০২৪ সালের উত্তাল জুলাই মাস বাংলাদেশের ইতিহাসে এক সংকটময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ষোলো বছরের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ, তরুণ সমাজ এবং ছাত্রসমাজের সম্মিলিত প্রতিরোধে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয় গণ-আন্দোলনের জোয়ার। ফ্যাসিবাদী সরকার সেই আন্দোলন দমন করতে জনগণের ওপর গুলি চালায়, গ্রেফতার করে, রাতের অন্ধকারে অভিযান চালিয়ে ছাত্রদের আটক করে এবং তথ্য গোপন করতে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়।
তিনি বলেন, মানুষের বুকে গুলি চালিয়ে ক্ষমতায় থাকার শেষ চেষ্টা করেছিল তারা। গুলিবিদ্ধ আহতদের চিকিৎসা না দিতে হাসপাতালগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই নিষ্ঠুরতা কতজনের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিয়েছে, কতজনকে চিরতরে পঙ্গু করেছে—তার কোনো পরিসংখ্যান আজও সম্পূর্ণ নয়।
প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে বলেন, দেশের বিপুল সংখ্যক তরুণ দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে আশাভঙ্গের শিকার হয়েছে। ভালো ফল করেও তারা চাকরির জন্য ক্ষমতাসীনদের দুয়ারে ঘুরেছে। দুর্নীতি, ঘুষ, তদবির ও রাজনৈতিক আনুগত্য ছাড়া কোনো চাকরি মেলেনি।
তিনি অভিযোগ করেন, সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটা পদ্ধতি দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির একটি সংগঠিত হাতিয়ার ছিল। এর বিরুদ্ধে তরুণদের দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চললেও, তৎকালীন সরকার তা আমলে নেয়নি। বরং, আন্দোলনকারীদের ওপর চালানো হয়েছে দমন-পীড়ন।
ড. ইউনূস তার বক্তব্যে আরও বলেন, এই দেড় দশকে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি খাতেই এক ধরনের সুবিধাভোগী শ্রেণি গড়ে তোলা হয়েছিল। যারা স্বৈরাচারের পক্ষে অবস্থান নিলেই পেত চাকরি, পদোন্নতি কিংবা ব্যবসা। বিচারব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি গণমাধ্যম ও সংস্কৃতির জগতেও এই মাফিয়াতন্ত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। দেশের গরিব-মেহনতি মানুষের সম্পদ লুটপাট করে গড়ে তোলা হয়েছিল টাকার পাহাড়।
তিনি বলেন, যারা সরকারের সমালোচনা করেছে কিংবা নাগরিক অধিকার নিয়ে কথা বলেছে, তাদের গুম, গ্রেপ্তার অথবা হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। লক্ষাধিক বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে আটক ও নির্যাতন করা হয়।
আরও পড়ুন: রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা
প্রধান উপদেষ্টা তার বার্তায় জানান, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতদের কল্যাণে সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। গত ডিসেম্বর মাসে এসব কার্যক্রমের প্রশাসনিক দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত করা হয়।
তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ৮৩৬টি শহীদ পরিবারের মধ্যে ৭৭৫টি পরিবারকে মোট ৯৮ কোটি ৪০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও মাসিক ভাতা বাবদ চেক প্রদান করা হয়েছে। বাকি পরিবারগুলোর জন্য প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
আহতদের বিষয়ে তিনি জানান, ১৩,৮০০ জন আহত জুলাইযোদ্ধাকে তিনটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে ১৫৩ কোটি ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
৭৮ জন গুরুতর আহত ব্যক্তিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, তুরস্ক ও রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে। চিকিৎসা ব্যয়ে ৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
সরকার ঘোষণা দিয়েছে, সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালে আহত জুলাইযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হবে।
ড. ইউনূস বলেন, “আমরা শুধু অতীত স্মরণ করতে আসিনি—আমরা আজ শপথ নিতে এসেছি। শপথ এই যে—আমরা আর কোনো নিপীড়নের কাছে মাথা নোয়াবো না। আমরা প্রতিষ্ঠা করব একটি জবাবদিহিমূলক, মানবিক, গণতান্ত্রিক এবং বৈষম্যহীন রাষ্ট্র। এমন রাষ্ট্র—যেটি সবসময় জনকল্যাণে কাজ করবে।
তিনি বলেন, জুলাই শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না। তাদের আত্মত্যাগই আমাদের পথচলার প্রেরণা, তাদের স্বপ্নই হবে আগামী বাংলাদেশের নির্মাণরেখা।
বক্তব্যের একাধিক অংশে অধ্যাপক ইউনূস স্মরণ করেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এদেশের মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও যখন সুবিচার অধরা, তখন জাতি আবার জেগে উঠেছে—এবার কলম, ব্যালট, চেতনা ও প্রতিবাদের শক্তি নিয়ে।
‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবসে’ ড. ইউনূসের এই বক্তব্য কেবল স্মরণ নয়—এটি ছিল জাতির সামনে এক ভবিষ্যতের রূপরেখা। যে ভবিষ্যত ভরসায়, ন্যায়বিচারে ও গণতান্ত্রিক চেতনায় গড়ে উঠবে, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের সম্মান ও অধিকার সুরক্ষিত থাকবে।
তিনি বলেন, আজকের শপথ হোক আমাদের আগামী দিনের দিকনির্দেশনা—এই দেশ হবে বৈষম্যহীন, মানবিক এবং সত্যিকার অর্থে জনকল্যাণমুখী।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি