৫ আগস্টের ঘটনা বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে নজিরবিহীন: তারেক রহমান

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ফাইল ছবি
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে যা ঘটেছে, এটি শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের ইতিহাসেও নজিরবিহীন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
গণঅভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) সকালে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় এ কথা বলেন তিনি ।
তারেক রহমানের পুরো বক্তব্য পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-
৫ আগস্ট। আজ থেকে ঠিক একবছর আগে ২০২৪ সালের এই দিনে ফ্যাসিস্ট বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়েছে। রাহুমুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতা প্রিয় গণতন্ত্র প্রিয় জনগণের জন্য দিনটি আনন্দের। দিনটি বিজয়ের। রাহুমুক্ত বাংলাদেশের এই দিনটিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘জুলাই গণ অভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাঁবেদারমুক্ত বাংলাদেশের জনগণ প্রতিবছর এই দিনটিকে স্বাধীনভাবে সানন্দে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে উপভোগ করবে। স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার চর্চার নতুন অঙ্গীকারে উদ্বুদ্ধ হবে।
একুশ শতকের এই বাংলাদেশে পলাতক স্বৈরাচার এক বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করেছিল। গুম-খুন অপহরণ হামলা-মামলা নির্যাতন নিপীড়ণকে সাধারণ এবং স্বাভাবিক ঘটনায় রূপান্তর করেছিল। এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে চলা আন্দোলনের সময় বিএনপিসহ ভিন্ন দল এবং মতের গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তির লাখো কোটি নেতাকর্মীর জন্য দেশকে নরকে পরিণত করে রাখা হয়েছিল। শত শত মিথ্যা মামলার কারণে ভিন্ন দল এবং মতের লাখ লাখ নেতাকর্মী সমর্থককে ঘরবাড়ি ছাড়া করে দেয়া হয়েছিল। অনেকের পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে।
গণতন্ত্রকামী মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করতে পলাতক স্বৈরাচারের নির্দেশে দেশে শত শত গোপন বন্দীখানা ‘আয়নাঘর’ বানানো হয়েছিল। সেই আয়নাঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জলজ্যান্ত মানুষকে দিনের পর দিন রাতের পর রাত বছরের পর বছর আটকে রাখা হতো। অনেককে চিরতরে গায়েব করে দেয়া হয়েছে। বিএনপির সাবেক এমপি ইলিয়াস আলী কিংবা কমিশনার চৌধুরী আলমের আজো খোঁজ মেলেনি।
বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশনসহ দেশের সকল সাংবিধানিক বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে দেয়া হয়েছিল। সংবিধান উপেক্ষা করে মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছিল। দেশকে চিরতরে তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিনষ্ট করার সকল আনুষ্ঠানিকতা প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিলো। বই খাতা ও কলমের পরিবর্তে রাজনীতির নামে শিক্ষার্থীদেরকে হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল লগি-বৈঠা-হাতুড়ি-চাপাতি।
বিপর্যস্ত করে দেয়া হয়েছিল দেশের অর্থনীতি। ব্যাঙ্কগুলোকে দেউলিয়া করে ফেলা হয়েছিল। দেশ থেকে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার করে দেয়া হয়েছে। অন্যায় অনিয়ম অনাচার দুরাচার লুটপাট দৈনন্দিন চিত্র হয়ে উঠেছিল। দেশে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল ব্যক্তিতন্ত্র।
তবে ফ্যাসিস্টের শেষ রক্ষা হয়নি। দেশের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ, ছাত্র জনতা, কৃষক শ্রমিক, রিক্সাওয়ালা, মুটে মজুর, গার্মেন্টস কর্মী, হোটেল রেস্তোরা কর্মী, পরিবহন শ্রমিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী,সংস্কৃতি কর্মী, গৃহবধূ, নারী শিশু এমনকি আমাদের মায়েরা সকলেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে জুলাই-আগষ্টের গণ অভ্যুত্থানে রাজপথে নেমে এসেছিল। গণ অভ্যুত্থান দমন করতে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। কোলের শিশু, শহিদ আবু সাঈদ, ওয়াসিম, মুগ্ধ, আমাদের এইসব সাহসী সন্তানদের বুকে গুলি করে শহীদ করে দেয়া হয়েছিল।
শুধুমাত্র ২০২৪ সালের জুলাই আগষ্টের গণঅভুত্থানেই দেড় হাজারের বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন। ছাত্র জনতা, কৃষক শ্রমিক, নারী শিশু বৃদ্ধ, সাংবাদিক, শ্রমজীবী, পেশাজীবী, ফ্যাসিস্টের গুলির নিশানা থেকে কাউকেই রেহাই দেয়া হয়নি। এই অভুত্থানে আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষ। হাত পা শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গ হারিয়ে আমাদের শত শত সন্তান, শত শত ভাই ও বোনেরা চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন কিংবা চোখ হারিয়ে আজীবনের জন্য অন্ধ হয়ে গেছেন।
এ জন্য আমি বলি, ১৯৭১ সাল ছিল স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ। আর ২০২৪ সালে ছিল স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ। ৭১ সালের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বাংলাদেশ ভোলেনি। ২৪ এর গণ অভ্যুথানের শহীদদেরকেও বাংলাদেশ ভুলবে না। ৭১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত দেশ এবং জনগণের স্বাধীনতা অর্জন, স্বাধীনতা রক্ষা, স্বৈরাচার এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন, গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এভাবে ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে লাখো মানুষ শহীদ হয়েছেন। আজকের এই দিনে আমি আবারো সকল শহিদদের অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আহতদের দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছি।
দেশ এবং জনগণের স্বাধীনতা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে শহীদগণ আমাদেরকে ঋণী করে গেছেন এবার শহীদের প্রতি আমাদের ঋণ পরিশোধের পালা। শহীদদের পরিবারের কাছে বাংলাদেশ ঋণী। দেশে জনগণের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে সাম্য মানবিক মর্যাদা সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি ইনসাফভিত্তিক গণতান্ত্রিক মানবিক বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমেই আমরা শহীদদের প্রতি ঋণ পরিশোধ করতে পারি।
আরও পড়ুন: জুলাই ঘোষণাপত্র অনুষ্ঠানে যাবেন বিএনপির পাঁচ শীর্ষ নেতা
একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম এবং রাজনৈতিক উদ্যোগ হচ্ছে জনগণের সরাসরি ভোটে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ জনগণের কাছে জবাবদিহিমূল একটি রাষ্ট্র এবং সরকার প্রতিষ্ঠা। জনগণের কাছে দায়বদ্ধ একটি সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ করছে।
বিগত দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের সঙ্গে স্বাধীনতা পরবর্তী তিন-সাড়ে তিনবছরের সময়কাল ছাড়া আর কোনো শাসনামলের তুলনা চলেনা। সুতরাং, আমি সবাইকে বিনীতভাবে আহবান জানাবো, হিটলারের নাৎসিবাদ সম্পর্কে যেমন কেউ গৌরব করেনা, পলাতক ফ্যাসিস্ট এর শাসনকাল নিয়েও গৌরব করার কিছু নেই। ডাকাতি করে কিছু সম্পদ চ্যরিটি করলেও জনগণের চোখে ডাকাত যেমন গ্রহণযোগ্য নয় তেমনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতা খুঁজতে গিয়ে কৌশলে পলাতক ফ্যাসিস্টয়ের পক্ষে সাফাই গাওয়াও তেমনি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
যারা কৌশলে ফ্যাসিবাদী শাসনের সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তুলনা করতে চান, তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে চাই, ৫ আগস্ট বাংলাদেশে যা ঘটেছে, এটি শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের ইতিহাসেও মনে হয় নজিরবিহীন। ৫ আগস্ট গণভবন ছেড়ে ফ্যাসিস্ট পালিয়েছে। সংসদ ভবন রেখে সাংসদ পালিয়েছে। আদালত ছেড়ে প্রধান বিচারপতি পালিয়েছে। বায়তুল মোকাররম ছেড়ে প্রধান খতিব পালিয়েছে। ক্যাবিনেট ছেড়ে মন্ত্রীরা পালিয়েছে। ফ্যাসিস্টের দোসররা গা ঢাকা দিয়েছে। তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, পলাতক এই ফ্যাসিস্ট চক্রের মনে এখনো কোনো অনুতাপ অনুশোচনা নেই।
হাজারো শহীদের রক্তস্নাত রাজপথে ফ্যাসিবাদবিরোধী অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে আর কখনোই ফ্যাসিবাদ কায়েম হবেনা,কাউকে গণতন্ত্র হত্যা করার সুযোগ দেয়া হবে না, বাংলাদেশকে আর কখনোই তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে দেয়া হবেনা। আমি মনে করি এসব প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য বহাল আছে, থাকবে।
ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশে যার যার দলীয় আদর্শ এবং লক্ষ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইস্যুভিত্তিক ভিন্নমত থাকবে। এটি বিরোধ নয় বরং ভিন্নমত। এটিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তবে ভিন্নমত কিংবা বিরোধের মাত্রা যেন ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ, চরমপন্থার উত্থান কিংবা পুনর্বাসনের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, সে ব্যাপারে প্রতিটি রাজনৈতিক দল এবং গণতন্ত্রকামি জনগণের প্রতি সতর্ক থাকার আহ্বান জানাই। আমি মনে করি, প্রতিটি রাজনৈতিক দল, যার যার দলীয় কর্মসূচি কিংবা এজেন্ডা নিয়ে জনগণের আদালতে যাবেন। জনগণ কোনটি গ্রহণ করবেন কিংবা বর্জন করবেন এটি সম্পূর্ণ জনগণের এখতিয়ার। এভাবেই প্রতিদিনের রাজনৈতিক চর্চার মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রে জনগণকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে।
স্থানীয় সরকার থেকে আরম্ভ করে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে জনগণ যখন সরাসরি নিজের পছন্দের প্রার্থীকে নিজের ভোট প্রয়োগ করে প্রতিনিধি নির্বাচন করে সরকার গঠন কিংবা সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা অর্জন করতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত রাষ্ট্র এবং সরকারে জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাই আসুন, রাষ্ট্র, সরকার, শাসন প্রশাসন পরিচালনা আর প্রতিদিনের কার্যক্রমে জনগণের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার চর্চা প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে আমরা জনগণকে শক্তিশালী করে তুলি। জনগণকে শক্তিশালী করে তুলতে না পারলে শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই শক্তিশালী এবং টেকসই হবে না।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের ঘৃণ্যতম ফ্যাসিস্ট পালিয়ে যাওয়ার পরপরই বীর জনতার উদ্দেশ্যে দেয়া অভিনন্দন বার্তায় আমি বলেছিলাম বিজয়ীর কাছে পরাজিতরা নিরাপদ থাকলে বিজয়ের আনন্দ মহিমান্বিত হয়। সেটি পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে দেশের গণতন্ত্রকামি জনগণের প্রতি আমার আহ্বান, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। মব ভায়োলেন্সকে উৎসাহিত করবেন না। নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করবেন না। অন্যের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুন।
‘মায়ের চোখে বাংলাদেশ’ যেমন আমরা তেমন একটি বাংলাদেশ গড়তে চাই যেখানে দলমত ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সংশয়বাদী প্রতিটি সন্তান প্রতি মানুষ নিরাপদে থাকবে। আজ এবং আগামীর প্রতিটি ‘৫ আগস্ট’ হয়ে উঠুক গণতন্ত্র সুশাসন প্রতিষ্ঠা আর মানবিক মানুষ হয়ে ওঠার অঙ্গীকারের দিন। এই সুমহান অঙ্গীকার বাস্তবায়নের দীর্ঘ যাত্রায় আমি এবং আমার দল বিএনপি দেশের সকল গণতন্ত্রকামী জনগণের সমর্থন এবং সহযোগিতা আশা করছি।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এসবি