আ. লীগের গোপন বৈঠক: গ্রেফতার ২২, সেনা হেফাজতে ১ মেজর

সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর সাদিকুল হক। ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর ভাটারা এলাকায় অবস্থিত বসুন্ধরা আবাসিক সংলগ্ন কে বি কনভেনশন সেন্টারের দ্বিতীয় তলায় গত ৮ জুলাই ২০২৫ তারিখে আয়োজিত একটি ‘গোপন বৈঠক’কে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ওই বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও সংশ্লিষ্ট সহযোগী সংগঠনের ৩০০ থেকে ৪০০ নেতাকর্মী। বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে ঢাকায় সহিংস উত্তেজনা সৃষ্টি করা।
এই গোপন বৈঠকের খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা নজরদারি শুরু করে।
একটি নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে, ১২ জুলাই উত্তরা পশ্চিম থানার দুটি পৃথক বাসা থেকে যুবলীগ নেতা সোহেল রানা ও আওয়ামী লীগ নেত্রী শামীমা নাসরিন শম্পাকে গ্রেফতার করে ভাটারা থানা-পুলিশ। দুজনই কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত বৈঠকের অন্যতম সংগঠক ও সমন্বয়কারী হিসেবে চিহ্নিত হন।
গ্রেফতারের পরদিন, ১৩ জুলাই, ভাটারা থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করেন এসআই জ্যোর্তিময় মণ্ডল। মামলায় সোহেল রানা ও শম্পার নাম প্রথম ও দ্বিতীয় আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
তাদের দেওয়া তথ্য ও প্রযুক্তিগত প্রমাণ বিশ্লেষণ করে জানা যায়, এই বৈঠকে বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগপন্থী নেতাকর্মীদের একত্র করে সাংগঠনিক পুনর্গঠন, সহিংস কর্মসূচি এবং সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত পদক্ষেপের পরিকল্পনা করা হয়।
বৈঠকে যে পরিকল্পনা হয়েছিল, তা ছিল সুস্পষ্ট ও সুগঠিত। উপস্থিত নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনার নির্দেশ পাওয়ার পর সারা দেশ থেকে ঢাকায় এসে সমবেত হবেন এবং শাহবাগ মোড়সহ কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে জনজীবন অচল করে তুলবেন। এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে শেখ হাসিনার দেশে ফেরাকে রাজনৈতিকভাবে “জরুরি ও অপরিহার্য” দেখানোর চেষ্টা করা হবে।
মামলার তদন্ত পরিচালনা করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের সক্রিয় নেতাকর্মী। তাদের অধিকাংশই ‘প্রিয় স্বদেশ’, ‘এফ ৭১ গেরিলা’, ‘বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম’, ‘প্রজন্ম ৭১’ ও ‘শেখ হাসিনা’ নামক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সদস্য। এসব গ্রুপে দেশব্যাপী সরকারবিরোধী কর্মসূচির পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণের তথ্য এবং সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানো হতো।
বিশেষভাবে আলোচনায় আসেন একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা—মেজর সাদিকুল হক ওরফে মেজর সাদিক। সোহেল রানা ও শম্পার জবানবন্দিতে উঠে আসে, মেজর সাদিকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এ বৈঠক আয়োজন করা হয়। তারই নির্দেশে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের ঢাকায় এনে নাশকতামূলক কার্যক্রমের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পূর্বে রাজধানীর আরও অন্তত চারটি স্থানে এমন প্রশিক্ষণ হয়েছে বলেও তারা জানান, তবে সংশ্লিষ্ট সব ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলা হয়েছে।
আরও পড়ুন: খালেদা জিয়ার কণ্ঠ নকল করে চাঁদাবাজি, সাড়ে ৫ কোটি টাকা ফ্রিজ
কে বি কনভেনশন সেন্টারে বৈঠকের দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সব সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ ছিল।
তদন্তে জানা যায়, এটি ছিল পরিকল্পিত। ওই কনভেনশন সেন্টারের ব্যবস্থাপক মুজাহিদকে এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে এবং তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশ বলছে, সিসিটিভি বন্ধ রাখা এবং অন্যান্য সহায়তার মাধ্যমে তিনিও ষড়যন্ত্রের অংশীদার হয়েছেন।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর সাদিক বর্তমানে সেনাবাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন।
সেনা সদরের প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম জানান, মেজর সাদিকের বিষয়ে আমরা অবগত। তার বিষয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না।
এছাড়া সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, তদন্তে দোষ প্রমাণিত হলে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, এই মামলায় এখন পর্যন্ত ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা সবাই বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের অবস্থান ও ভূমিকা যাচাই করা হচ্ছে। প্রয়োজনে অন্যদের রিমান্ডে এনে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অনেকেই দেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থান করছে, তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর ভেতরে এক ধরনের ছায়া রাজনীতির ইঙ্গিত স্পষ্ট। সংগঠনের নিষিদ্ধ অংশগুলো আবারো সক্রিয় হয়ে উঠছে এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বহীনতার সুযোগে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। শেখ হাসিনার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে এমন একটি শক্তি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে পারে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
বিশেষ করে সেনা কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা এ ঘটনায় বাড়তি গুরুত্বের সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক সংঘাতে সাবেক সামরিক ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সংবিধানিক ভারসাম্যের প্রশ্ন তুলেছে।
এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তা থেকে স্পষ্ট যে, একাধিক স্তরে সংগঠিত এই বৈঠক শুধুমাত্র একটি বিচ্ছিন্ন ষড়যন্ত্র নয়, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের একটি অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
সার্বিকভাবে, এই গোপন বৈঠক ও তার পরবর্তী তদন্তে পাওয়া তথ্য দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
তদন্ত চলমান এবং পুলিশ জানিয়েছে, এ ষড়যন্ত্রে জড়িত সকলকে আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যে অভিযান অব্যাহত থাকবে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি