৩৫ বছর পর রাকসু নির্বাচন, প্রস্তুত ভোট কেন্দ্র

ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (রাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন।
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলবে ভোটগ্রহণ। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পাচ্ছেন প্রায় ৩৫ বছর পর।
রাকসু নির্বাচন কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, সকাল সোয়া ৭টা থেকেই কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে ব্যালট বাক্স, ওএমআরযুক্ত ব্যালট পেপার, ভোটার তালিকা, অমোচনীয় কালি এবং অন্যান্য নির্বাচনী সামগ্রী। প্রিজাইডিং অফিসারদের কাছে সরঞ্জাম হস্তান্তরের পর ভোটগ্রহণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়।
রাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রফেসর ড. এফ নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিটি কেন্দ্রে নির্বাচনী সরঞ্জাম পৌঁছে গেছে। সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ নিশ্চিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ১০০টি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। সব মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে মোট ২৮ হাজার ৯০১ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১৭ হাজার ৫৯৫ জন (৬০.৯০%) এবং নারী ভোটার ১১ হাজার ৩০৬ জন (৩৯.১০%)। আবাসিক শিক্ষার্থী ৯ হাজার ২৫১ জন, অনাবাসিক ১৯ হাজার ৬৫০ জন।
রাকসু, হল সংসদ ও সিনেট মিলিয়ে ৮৬০ জন প্রার্থী ভোটযুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন—রাকসুর ২৩ পদে ২৪৭ জন, ১৭টি হল সংসদের ২৫৫ পদে ৫৯৭ জন এবং সিনেটের ৫ পদে ৫৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
রাকসুর সহসভাপতি (ভিপি) পদে ১৮ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ১৩ জন এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে ১৬ জন লড়ছেন। প্রতিটি ভোটারকে মোট ৪৩টি পদে ভোট দিতে হবে এবং একজন ভোটারের জন্য ১০ মিনিট সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: ৩৫ বছর পর চবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন শুরু
নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক পারভেজ আজহারুল হক জানান, একজন ভোটার বুথের ভেতরে ১০ মিনিটের বেশি অবস্থান করতে পারবেন না। ভোটদানের মোট সময় হিসাব করেই এই সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি একাডেমিক ভবনে স্থাপিত ১৭টি কেন্দ্রে। এতে মোট ৯০৯ থেকে ৯৯০টি বুথ ব্যবহার করা হচ্ছে। নির্বাচন পরিচালনায় আছেন ২১২ জন শিক্ষক—এর মধ্যে ১৭ জন প্রিজাইডিং অফিসার, বাকিরা সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আশপাশে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। বুধবার (১৫ অক্টোবর) সকাল থেকেই শুরু হয় বহিরাগত ও যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, মোটাদাগে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকেরা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। আগামী দুই দিন যদি সবাই এই আচরণ বজায় রাখেন, তাহলে নির্বাচন স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৬৪ সালে বর্তমান ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করে। প্রথম ছাত্র সংসদ ছিল ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন’ নামে। ১৯৫৬-৫৭ ও ১৯৫৭-৫৮ শিক্ষাবর্ষে প্রথমবার অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন।
রাকসুর সাবেক কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আব্দুর রহমানের প্রবন্ধে উল্লেখ আছে, প্রথম নির্বাচন আদায়ের জন্য শিক্ষার্থীদের ধর্মঘট পর্যন্ত করতে হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী স্মারকপত্র অনুযায়ী, ‘ছাত্র ইউনিয়ন’ ও ‘রাকসু’ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ১৬ বার ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে—এর মধ্যে ১০টি স্বাধীনতার আগে এবং ৬টি পরে (১৯৭২–৭৩, ১৯৭৩–৭৪, ১৯৭৪–৭৫, ১৯৮০–৮১, ১৯৮৮–৮৯ ও ১৯৮৯–৯০)।
শেষ রাকসু নির্বাচন হয় ১৯৮৯–৯০ শিক্ষাবর্ষে, যেখানে ভিপি হন ছাত্রদলের রুহুল কবির রিজভী এবং জিএস পদে জাসদ ছাত্রলীগের রুহুল কুদ্দুস। এরপর দীর্ঘ ৩৫ বছর কোনো নির্বাচন হয়নি।
সুজনের রাজশাহী জেলা সভাপতি আহমদ সফিউদ্দিন বলেন, পঞ্চাশের দশকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ছিল নেতৃত্ব বিকাশের ক্ষেত্র। ষাটের দশকে তা রাজনৈতিক হয়ে ওঠে, পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের অংশ হয়। স্বাধীনতার পর ক্ষমতাসীনদের বিপরীত মতাদর্শী প্রার্থীরা জয়ী হওয়ায় সরকার ভয় পেত। এ কারণেই পরে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়।
সাবেক রাকসু নেতা ও শিক্ষকরা বলছেন, রাকসুর মূল কাজ শিক্ষার্থীদের দাবি–দাওয়া উপস্থাপন করা ও প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করা। রাকসু না থাকায় দীর্ঘদিন শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি অনুপস্থিত ছিল, ফলে সমস্যা সমাধানে প্রশাসনিক অচলাবস্থা তৈরি হয়।
অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে ক্রীড়া, বিতর্ক, সাহিত্য—সবক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা কাজ করতেন। নির্বাচন ছিল উৎসবের মতো। এখন সেই চর্চা ফিরিয়ে আনতে হবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মাহিন সরকার বলেন, রাকসু নির্বাচন হলে হানাহানি কমবে, দলীয় রাজনীতির প্রভাব হ্রাস পাবে এবং শিক্ষার পরিবেশ ফিরবে।
রাকসু নির্বাচনে ১০টিরও বেশি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দুটি—ছাত্রদল-সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ এবং ছাত্রশিবির-সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’।
এছাড়া রয়েছে ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’ (বামপন্থী জোট), ‘রাকসু ফর র্যাডিক্যাল চেঞ্জ’ (ছাত্র অধিকার পরিষদ ও ছাত্র ফেডারেশন নেতৃত্বে), ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ (বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়করা), ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ (নারী প্রার্থী তাসিন খানের নেতৃত্বে), ‘অপরাজেয় ৭১, অপ্রতিরোধ্য ২৪’ (ছাত্র ইউনিয়ন একাংশ), ‘সচেতন শিক্ষার্থী পরিষদ’ (ইসলামী ছাত্র আন্দোলন মনোনীত)।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন পুনরায় শুরু হয়। ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে—যেখানে অধিকাংশ পদে জয়ী হয়েছে ছাত্রশিবির–সমর্থিত প্যানেল।
রাকসুর তফসিল ঘোষণা হয়েছিল গত ২৮ জুলাই। তবে আন্দোলন ও প্রশাসনিক জটিলতায় ভোট তিন দফায় পিছিয়ে আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
রাকসুর সংবিধান অনুযায়ী, এর মূল কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন, সাময়িকী প্রকাশ, মানবহিতৈষী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, বিতর্ক ও বক্তৃতার আয়োজন, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, আন্তবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতা ও পরিবেশবিষয়ক সম্মেলনে অংশগ্রহণ ইত্যাদি।
নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক মোস্তফা কামাল আকন্দ বলেন, মূল লক্ষ্য একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়া। প্রতিটি ধাপে আমরা বিতর্কমুক্ত প্রক্রিয়া নিশ্চিতের চেষ্টা করছি।
রাকসু নির্বাচন ২০২৫ সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান
ভোটার: ২৮,৯০১ জন
নারী ভোটার: ১১,৩০৬ (৩৯.১%)
পুরুষ ভোটার: ১৭,৫৯৫ (৬০.৯%)
কেন্দ্র: ১৭টি
মোট পদ: ২৮৩টি
প্রার্থী: ৮৬০ জন
সিসিটিভি: ১০০টি
ভোটগ্রহণ সময়: সকাল ৯টা – বিকেল ৪টা
ফল ঘোষণা: ভোট শেষে ১৭ ঘণ্টার মধ্যে
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭২ বছরের ইতিহাসে ১৭তম রাকসু নির্বাচন আজ শুধুমাত্র একটি ভোটযুদ্ধ নয়—এটি দীর্ঘ রাজনৈতিক অচলাবস্থা ভেঙে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক অধ্যায়।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি