যশোর টিটিসির তাকামুল সনদের মূল চ্যানেল আর অনৈতিক লেনদেন
ছবি: সংগৃহীত
চ্যানেল ছাড়া মেলে না যশোর টিটিসি সেন্টারের তাকামুল (Takamol Certificate) সনদ। চ্যানেলের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা দিলেই তবে মেলে তাকামুল নামের এ সোনার হরিণ। না হলে মাসের পর মাস শুধু পরীক্ষা দিতে হয়। মেলে না কৃতকার্য সনদ। সনদ না পাওয়ায় ফলে মাসের পর মাস সৌদিগামীদের অপেক্ষায় থাকতে হয়।
সম্প্রতি সরজমিন অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা যায়, যশোর টিটিসির জব রিপ্লেসমেন্ট রুমে ইন্সটেকক্টর আব্দুল আল মামুন ও জব রিপ্লেসমেন্ট দেলোয়ার হোসেন নামে দুইজন টিটিসি সেন্টারের কর্মকর্তা এসব টাকার ভাগ বাটোয়ারা করছেন। রুমের ভিতর প্রবেশ করার সাথে সাথেই টাকাগুলো লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন তারা। তার কিছু সময় পরে আব্দুল আল মামুনকে পরীক্ষা কেন্দ্রের ভিতরে দেখা যায়। এসময় কিছু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে দেখা যায় তাকে।
টাকা লেনদেনের বিষয়ে ইন্সেটেক্টর মামুন রশিদের মুঠোফোনে কয়েক দফায় সংযোগ দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
অনৈতিকভাবে টাকা লেনদেনের বিষয়ে জব রিপ্লেসমেন্ট অফিসার দেলোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাকামূল সনদ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। এটা আব্দুল মামুন সাহেব ভালো বলতে পারবেন।
মনিরামপুর থেকে যশোর টিটিসিতে পরীক্ষা দিতে আসা বিদেশগামী শ্রমিক ইমন জানান, আমি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছি। আমি এর আগে ৫০০ ডলারের বিনিময়ে রেজিস্ট্রেশন করে দুইবার পরীক্ষা দিয়েছি কিন্তু প্রতিবারই আমাকে অকৃতকার্য দেখিয়েছে। এবার ট্রাভেলস এজেন্সির মাধ্যমে তাকামুল সনদের জন্য ২৫ হাজার টাকা চুক্তিতে পরীক্ষা দেই। তাই এবার- পাশ করেছি। অথচ এর আগের দুইবার এর থেকে ভালো পরীক্ষা দিয়েছি কিন্তু প্রতিবারে অকৃতকার্য দেখিয়েছে। এবার তার থেকে খারাপ পরীক্ষা দিয়েও পাশ করেছি।
যশোর নিউমার্কেট এলাকার প্রান্ত নামে এক পরীক্ষার্থী জানান, চ্যানেল ছাড়া এখানে কেউই পাস করে না। যারা একটু কম্পিউটারের মাউস ধরতে পারে তারা কম্পিউটারে ১৫টি প্রশ্নের উত্তর অনায়াসে দিতে পারেন। আর বাকি সব প্র্যাকটিক্যালে। চ্যানেলের বাইরে আসা পরীক্ষার্থীদের প্র্যাকটিকালে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে তাদেরকে ঘাবড়ে দেওয়া হয়। আর এসব স্ক্রিনশট ব্যাড লিখে তারা সৌদি আরবে পাঠান এবং ওয়েবসাইটে তাদেরকে অকৃতকার্য ঘোষণা করা হয়। আর যারা কিছুই না পারে শুধুমাত্র চ্যানেলের মাধ্যমে আসেন তাদেরকে বলেন কোন কিছু না পারলে এদিক ওদিক না তাকিয়ে নির্দিষ্ট কাজের দিকেই মনোযোগী থাকবেন তাহলেই পাস। এবং তাদের সেই স্ক্রিনশট গুড বলে সৌদি আরবে প্রেরণ করেন এসব প্রশিক্ষকরা। ফলে অদক্ষ অজ্ঞ অশিক্ষিত শ্রমিকরা অনায়াসে তাকামূল সনদ পেয়ে যান। পক্ষান্তরে শিক্ষিত দক্ষ শ্রমিকরা অকৃতকার্য হয়ে সনদ থেকে বঞ্চিত হন।
নড়াইল থেকে আসা আব্দুল আল মামুন বলেন, এখানে সবকিছু চ্যানেলের মাধ্যমে হয়। চ্যানেল না ধরলে কেউই পাস করবে না। অনেকে এখানে আছে নিজের নামও স্বাক্ষর করতে পারে না। এমনকি তারা কম্পিউটারের মাউস জীবনে কখনো ধরেনি। তারা অনায়াসে পাশ করে যাচ্ছে। অথচ আইএ, বিএ পাস শিক্ষার্থীরা অকৃতকার্য হচ্ছে। চ্যানেল ছাড়া এখানে কেউ পাস করতে পারে না।
কুমিল্লা থেকে আসা সজীবও জানান একই কথা- চ্যানেল ছাড়া কেউ পাস করে না। হয় লোকাল চ্যানেল, না হয় এজেন্সির চ্যানেলের মাধ্যমে আসলেই পাস। আমি নিজেই কম্পিউটার দোকান থেকে রেজিস্ট্রেশন করে পরীক্ষা দিয়েছি। তাই পাস করিনি। অথচ অক্ষর জ্ঞানহীন ব্যক্তিরা এজেন্সির মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে সবাই পাস করেছে।
আরও পড়ুন: নোয়াখালীতে বীর নিবাসের কাজে দুর্নীতি, ঘর বুঝে না পেয়ে হতাশা
সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, ২০২৫ সাল থেকে যশোর খুলনাসহ দেশের বিভাগীয় TTC Center গুলোতে ১২৫ মার্কের তাকামুল (Takamul) পরীক্ষার প্রশ্ন ৩ টি ধাপে বিভক্ত হয়ে থাকে। যেমন-কম্পিউটার টেস্ট, প্রাকটিকাল টেস্ট এবং ভাইভা। অনলাইনে (১৫×২=৩০) ১৫টি প্রশ্ন থাকে, তার মধ্যে কমপক্ষে পাঁচটি প্রশ্ন কম্পিউটার মাউসের মাধ্যমে টিক দিয়ে ১০ নম্বার পেলেই উত্তীর্ণ হয়। বাকিগুলোর উত্তর সঠিক না হলেও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অনলাইনে হওয়ায় শুধুমাত্র এই ১০ নাম্বার সৌদি কর্তৃপক্ষের হাতে থাকে। আর বাকি ১১৫ নম্বার টিটিসি সেন্টারের প্রশিক্ষকদের হাতে থাকে। তাই চাইলেই যেকোনো বিদেশগামী শ্রমিকদের কৃতকার্য করা বা অকৃতকার্য করা অনায়াসেই সম্ভব। বিদেশগামী শিক্ষার্থীরা চ্যানেল ছাড়া অনায়াসে কম্পিউটার টেস্টে উত্তীর্ণ হলেও প্র্যাকটিক্যাল ও ভাইভা টেস্টে তাদেরকে অনৈতিকভাবে অকৃতকার্য দেখানো হয়।
বিষয়টি নিয়ে যশোর টিটিসির অধ্যক্ষ গাজী ইকফাত হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব অনিয়ম আমি একা রুখতে পারবো না। এরা এখানে দীর্ঘদিন থেকে এসব অনৈতিক কাজের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। এর আগেই আমি তাদের সতর্ক করে দিয়েছি। ‘যদি আপনারা আমাকে সহযোগিতা করেন তাহলে সহজ হবে’ বলে তিনি জানান।
উল্লেখ্য সম্প্রতি সৌদি আরবের শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে বিদেশি শ্রমিকদের সৌদি সরকারের 'তাকামুল' বা স্কিল সার্টিফিকেশন এ সনদ বাধ্যতামূলক করেছে সৌদি সরকার। এখন শুধু পাসপোর্ট আর মেডিকেল রিপোর্ট যথেষ্ট নয়।
‘তাকামুল’ নামের এ পেশাগত দক্ষতা যাচাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াও বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে। এই পরীক্ষায় পাস না করলে ভিসা বাতিল, চাকরি বাতিল সবই সম্ভব। ফলে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক নতুন আতঙ্ক। এ সনদ ছাড়া সৌদি যাওয়া এখন প্রায় অসম্ভব। আর এই সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে যশোরসহ বাংলাদেশের টিটিসি সেন্টারের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। যশোর টিটিসি সেন্টারের কর্মকর্তারাও এই সনদকে পুঁজি করে এজেন্সি ও অসাধু দালালদের মাধ্যমে কামাই করছে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা।
বিদেশি শ্রমিকদের পেশাগত দক্ষতা যাচাইয়ে এই সনদ মূলত কারিগরি, নির্মাণ, ইলেকট্রিক, প্লাম্বিং, মেকানিক, হোটেল পরিষেবা ইত্যাদি খাতে প্রযোজ্য হয়। আর চ্যানেলের দালাল বা ট্রাভেল এজেন্সি ছাড়া এ সনদ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। চ্যানেল ছাড়া শিক্ষিত ও দক্ষ বিদেশগামী শ্রমিকদের যশোর টিটিসি সেন্টারসহ দেশের প্রায় সব টিটিসি সেন্টারে অকৃতকার্য দেখানো হচ্ছে। অথচ কোনরকম নাম স্বাক্ষরকারী অজ্ঞ ও অদক্ষ শ্রমিকদের প্র্যাকটিক্যলেও নির্ভাবনায় উত্তীর্ণ দেখানো হচ্ছে। সবই হয় চ্যানেলের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে।
‘তাকামুল’ নিয়ে তাই বিদেশগামী শিক্ষিতও দক্ষ শ্রমিকরা পড়েছেন নানা বিড়ম্বনায়। বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট টিটিসির অধ্যক্ষের নিকটে জানিয়েও কোন সুরাও মিলছে না বলে অভিযোগ রয়েছে ভুক্তভোগীদের।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এনডি








