তোর জন্য এসেছিলাম মা, তুই কেন লাশ হয়ে এলি?

ছবি: সংগৃহীত
প্রবাস থেকে দীর্ঘ আড়াই বছর পর স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফেরার পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় এক পরিবারের সাতজন নিহত হয়েছেন।
বুধবার (৬ আগস্ট) ভোরের অন্ধকারে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ পূর্ব বাজারের কাছে মাইক্রোবাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খালে পড়ে যায়।
এতে বাহার উদ্দিন ও তার পরিবারের সাতজন সদস্য পানিতে ডুবে মারা যান। পরিবারের বাকি ছয়জন এবং চালক গুরুতর আহত হলেও জীবিত রয়েছেন।
নিহতদের মধ্যে ছিলেন দুই শিশুসহ বাহারের মা, স্ত্রী, মেয়ে, নানী, বড় ভাইয়ের স্ত্রী এবং দুই ভাতিজি।
ওমান প্রবাসী মো. বাহার উদ্দিন প্রায় আড়াই বছর পর দেশে ফিরছিলেন। তিনি এবং পরিবারের অন্যরা ঢাকা বিমানবন্দর থেকে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের পশ্চিম চৌপল্লী গ্রামের বাড়ি ফেরার পথে একটি মাইক্রোবাসে উঠেন। মাইক্রোবাসে ছিলেন মোট ১৩ জন। ওই গাড়ি বেগমগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ পূর্ব বাজার এলাকায় পৌঁছানোর আগে চালকের ঘুমিয়ে পড়ার কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি পাশের খালে পড়ে যায়।
দুর্ঘটনার সময় গাড়ির চালক পানির মধ্যে থেকে বের হয়ে পালিয়ে যান। বাহার উদ্দিনসহ পাঁচজন গ্লাস ভেঙে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। কিন্তু বাকিদের মধ্যে সাতজন গাড়ির ভেতরে আটকা পড়ে প্রায় দুই ঘণ্টা পানির নিচে থাকেন। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের রেকার দিয়ে গাড়িটি তুলে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
আরও পড়ুন: নোয়াখালীর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত একই পরিবারের ৭ জনের পরিচয় মিলেছে
বেঁচে ফেরা যাত্রীরা হলেন বাহার উদ্দিন, তার বাবা আবদুর রহিম, শ্বশুর ইস্কান্দর মির্জা, শ্যালক রিয়াজ, ভাইয়ের স্ত্রী সুইটি এবং চালক রাজু।
নিহতরা হলেন—
- মুরশিদা বেগম (৫০) (বাহার উদ্দিনের মা)
- কবিতা আক্তার (২৪) (বাহারের স্ত্রী)
- মীম আক্তার (২) (বাহারের মেয়ে)
- ফয়জুন নেছা (৭০) (বাহারের নানী)
- লাবনী আক্তার (২৫) (বড় ভাইয়ের স্ত্রী)
- রেশমি আক্তার (৯) (ভাতিজি)
- লামিয়া আক্তার (৮) (ভাতিজি)
শোকাহত বাহার উদ্দিন বলেন, তোর জন্য এসেছিলাম মা, তুই কেন লাশ হয়ে এলি?
তিনি বার বার ২ বছরের মেয়ে মীম আক্তারের নিথর দেহ বুকে নিয়ে চিৎকার করেন। নিহত দুই শিশুর স্কুলব্যাগ ও নতুন বইয়ের দিকে দৃষ্টির প্রতিবিম্বে পরিবারের বেদনা আরও গভীর।
বাহারের শ্বশুর ইস্কান্দর মির্জা অভিযোগ করেন, চালকের ঘুমেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমাদের দাবি চালকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।
তিনি জানান, বিকেল ৫টায় পশ্চিম চৌপল্লীর কাচারিবাড়ি গ্রামে ছয়জনের দাফন সম্পন্ন হবে। আর নানী ফয়জুন নেছাকে তার নিজ গ্রাম চর মোহাম্মদপুরে দাফন করা হবে।
চন্দ্রগঞ্জ হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোবারক হোসেন বলেন, এটি শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, পুরো একটি পরিবারের নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ঘটনা। চালকের ঘুমিয়ে পড়ার কারণে এ ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। চালক পলাতক রয়েছে। তার বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী বিআরটিএ অফিসের কর্মকর্তারা দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং চালকের ত্রুটির বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।
বাড়িতে ফিরে আসার আনন্দ মুহূর্তেই বিপর্যয় নেমে আসে। পরিবার ও এলাকার লোকজন শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েন। একসঙ্গে সাতজনের মৃত্যুতে পুরো এলাকার পরিবেশ ভারাক্রান্ত। নিহত দুই শিশুর পড়াশোনার নতুন বই ও স্কুলব্যাগের দিকে নিথর চোখে তাকিয়ে থাকা অভিভাবকদের করুণ চিত্র শোকে আরও গভীরতা যোগ করেছে।
বাহার উদ্দিন জানান, তারা চলার পথে চালককে কয়েকবার সতর্ক করে রেস্ট নেওয়ার জন্য বললেও চালক সেই কথাগুলো শোনেননি। শেষ পর্যন্ত তার ঘুমের অবহেলা পুরো পরিবারের ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনে।
তিনি জানান, আমি কীভাবে এ শোক সইব? নিজের স্ত্রী, সন্তানের প্রাণ গেল, মা হারালাম, ভাইয়ের পরিবার হারালাম।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি