লাঙ্গলবন্দের বেশিরভাগ সম্পত্তিই প্রভাবশালীদের দখলে!
নারায়ণগঞ্জ: হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান লাঙ্গলবন্দের ৪৬ একর সম্পত্তির বেশিরভাগই দখল হয়ে গেছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাতে। যেটুকু বাকি আছে, তারও অধিকাংশের অবস্থা জরাজীর্ণ। এ সম্পত্তির সঠিক কোনো তথ্য নেই ভূমি অফিসেও। আর সে সুযোগেই দখলদাররা একের পর এক গড়ে তুলছে অবৈধ স্থাপনা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পঞ্চমী ঘাট থেকে শুরু করে সাবদী কালী মন্দির ঘাট পর্যন্ত নদের দুই পাড়ই চলে গেছে দখলদারদের হাতে। রাজঘাট থেকে প্রেমতলা ঘাট পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশ দখল করে গড়ে উঠেছে দোকানপাট ও বাসা। ব্রহ্মপুত্রের পাড় একের পর এক এভাবে দখল হতে থাকলেও প্রশাসন দেখাচ্ছে চরম ঔদাসীন্য।
অভিযোগ রয়েছে, দেবোত্তর সম্পত্তি ও খাস সম্পত্তি দখল করে নিজেদের নামে জাল দলিল (খাড়া দলিল) বানিয়ে এসব সম্পত্তি দখল করা হচ্ছে। সরেজমিন অনুসন্ধান ও স্থানীয়দের অভিযোগে বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য। লাঙ্গলবন্দের মূল এলাকায় ৪৪ শতাংশ জায়গা শাহ আলম তরফদার নামে একজন দখল করে রেখেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ব্রহ্মা মন্দির থেকে দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির হয়ে প্রেমতলা পর্যন্ত জায়গার ৬ একর ৪৪ শতাংশ সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়েছে জ্যোতি কোম্পানি। অন্নপূর্ণা ঘাট সংলগ্ন ৪৩ শতাংশ জায়গা দখল করেছে মৃত আলাউদ্দিন ভেন্ডারের ছেলে জনি।
এছাড়াও কুমারপাড়া এলাকায় নিমাই ঠাকুর মন্দির সংলগ্ন ৬ শতাংশ জায়গা দখল করেছেন স্থানীয় বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। অভিযোগ রয়েছে, ওই সব জায়গার জাল দলিল তৈরি করে বেচা-কেনায় সক্রিয় রয়েছে স্থানীয় দালাল চক্রের হোতা মোক্তার হোসেন। তিনি আরও বেশ কিছু জায়গা বিক্রির প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।
এ ব্যাপারে লাঙ্গলবন্দ ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “কিছু কিছু জায়গার কাগজপত্র ত্রুটিপূর্ণ আছে। আবার বেশকিছু জায়গা নিয়ে মামলাও চলছে।” লাঙ্গলবন্দে দেবোত্তর সম্পত্তির বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে না পারলেও জাহাঙ্গীর জানান, সেখানে ৬২ শতাংশ লিজভুক্ত জায়াগা, ৩৮৭ শতাংশ অর্পিত সম্পত্তির সঙ্গে আরও কিছু জায়গা তফসিলভুক্ত আছে। এসব জায়গার সঠিক কোনো রেকর্ড নেই।
জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শংকর কুমার সাহা ও মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দ জনকল্যাণ সমিতির সভাপতি আশানন্দ বিশ্বাস জানান, লাঙ্গলবন্দের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৪৬ একর যা সিএস পরচায় নথিভুক্ত রয়েছে। সেই জমি তদানীন্তন সাত জমিদার মিলে দান করে গেছেন। ৬৪ সালের রায়টে (হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা) ও একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে লাঙ্গলবন্দের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিই হারিয়ে গেছে।
বেদখলকৃত জায়গা পুনরুদ্ধারের দাবি জানিয়ে এ দুই নেতা বলেন, “এসব জায়গা উদ্ধার করা হলে লাঙ্গলবন্দ তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে।”
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত দেবনাথ বলেন, “স্থানীয় কয়েকটি কারখানা ইটিপি ছাড়াই পরিচালনা করছে। তাদের ময়লা ও বিষাক্ত পানি নদে গিয়ে মিশছে যার কারণে জল দূষিত হয়ে পড়েছে। এছাড়াও নদে অপরিকল্পিতভাবে মাছের ঘের তৈরি করায় কচুরী পানায় নদ সয়লাব হয়ে গেছে।”
এ প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, “লাঙ্গলবন্দের বেদখলকৃত জমির ব্যাপারে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। যদি কেউ জোর পূর্বক ও কিংবা জাল দলিল দিয়ে দখল করে থাকে সেগুলো উদ্ধার করা হবে।”
ঢাকায় নদী খনন সম্পর্কিত টাস্কফোর্সের বৈঠকে ব্রহ্মপুত্র নদ খননের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেও জানান তিনি। বন্দর উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) নাহিদা বারিক বলেন, “কোনো দালাল চক্র ওই এলাকার জমি বেচা-কেনার সাথে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
প্রসঙ্গত, নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নে মূলত লাঙ্গলবন্দের মূল তীর্থ স্নানোৎসব হলেও এটি ছড়িয়ে পড়েছে ধামগড় ইউনিয়ন ও সাবদী ইউনিয়নসহ পাশের সোনারগাঁয়েও। প্রায় দেড়শ বছর আগে ওই অঞ্চলের সাত জমিদার মিলে তীর্থস্থানের জন্য ৪৬ একর (চার হাজার ছয়শ শতাংশ) জমি দান করেন। রেকর্ড অনুযায়ী তীর্থযাত্রীদের ও পুণ্যার্থীদের কথা চিন্তা করে জমিদার কালী নারায়ণ চৌধুরী নিজে দিয়েছিলেন ৬ একর ৬২ শতাংশ জমি। গত দেড়-দুই শ বছরে এই এলাকাজুড়ে পর্যায়ক্রমে গড়ে উঠে ১৬টি স্নানঘাট ও ১০টি মন্দির ও ১০টি আশ্রম। এ বছর পুণ্যস্নান করতে এসে দশজন মারা গেছেন লাঙ্গলবন্দে। এরপর থেকেই স্থানীয় প্রশাসন অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে উঠেছে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এমএ/একে
নিউজবাংলাদেশ.কম








