এমপি কোটার ৩০ বিলাসবহুল গাড়ি হস্তান্তরে এনবিআরের সিদ্ধান্ত

ছবি: সংগৃহীত
শুল্কমুক্ত সুবিধায় এমপি কোটায় আমদানি করা ৩০টি ল্যান্ড ক্রুজার পাজেরো গাড়ি বিক্রির পরিবর্তে রাষ্ট্রায়ত্ত যানবাহন অধিদপ্তরে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
প্রতিটি গাড়ির বাজারমূল্য ১২ কোটি টাকার বেশি হলেও নিলামে মাত্র ১ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকার দর পড়ায় এনবিআরের এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এনবিআর ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজকে গাড়িগুলো হস্তান্তরের জন্য চিঠি দিয়েছে।
দ্বাদশ সংসদের সদস্যরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়িগুলো আমদানি করেছিলেন। তবে সরকার পরিবর্তনের আগে গাড়িগুলো ছাড়ের পূর্বেই নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের উপ-কমিশনার এইচ এম কবীর বলেন, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা গাড়িগুলো এখন যানবাহন অধিদপ্তরে হস্তান্তর করা হবে। ৩০টির মতো গাড়ি রয়েছে, যেগুলো বিধিমালা অনুযায়ী হস্তান্তর করা হবে।
২০২২ মডেলের এসব গাড়ির প্রতিটি আমদানি মূল্য ছিল দেড় কোটি টাকা। ৮০০ শতাংশ শুল্কের কারণে বাংলাদেশে বাজারমূল্য ১২ কোটি টাকার বেশি। তবে প্রথম নিলামে বিডাররা গাড়িগুলোর জন্য মাত্র ১ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকার দর দিয়েছেন। এনবিআরকে রাজস্ব রক্ষার জন্য ভিন্ন পন্থা নিতে হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম বিডার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. ইয়াকুব চৌধুরী বলেন, প্রথম নিলামে ৬০ শতাংশ দর পূর্ণ হলে আমরা গাড়ি কিনতে পারতাম না, আবার বাজারেও বিক্রি সম্ভব হত না। কিন্তু এক-দেড় বছর পর নতুন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, এটি সরকারের সিদ্ধান্ত। বন্দরের কোনো আপত্তি নেই। তবে এতদিন গাড়ি রাখার খরচ কাস্টমস থেকে নেওয়া হবে।
শুধু এমপি কোটার ৩০টি গাড়ি নয়, ২০ বছরের বেশি সময় ধরে অন্তত ৩০০ গাড়ি বন্দরে আটকে রয়েছে।
সাবেক সহ-সভাপতি মো. গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী বলেন, উপযুক্ত দাম না পেয়ে কাস্টমস পণ্য নিষ্পত্তি করে না। যদি ভালো কন্ডিশনে গাড়িগুলো নিষ্পত্তি করা যেত, বন্দর অনেক বেশি রাজস্ব আয় করতে পারত।
সরকার পতনের ঠিক আগ মুহূর্তে গাড়ি ছাড় পেয়েছিলেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, ব্যারিস্টার সুমনসহ অন্তত ৭ জন। আটকা পড়াদের মধ্যে রয়েছে অভিনেত্রী তারানা হালিম, জান্নাত আরা হেনরী, ময়মনসিংহের আবদুল ওয়াহেদ, জামালপুরের আবুল কালাম আজাদ, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের এস আল মামুন, বাঁশখালীর মুজিবুর রহমান, খুলনার এস এম কামাল হোসাইন, নওগাঁর সুরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, গাইবান্ধার শাহ সারোয়ার কবির, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এস এ কে একরামুজ্জামান, নেত্রকোনার সাজ্জাদুল হাসান, ঝিনাইদহের নাসের শাহরিয়ার জাহেদী, যশোরের তৌহিদুজ্জামান এবং সুনামগঞ্জের মুহাম্মদ সাদিক।
সাবেক এমপিদের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা ৩০টি গাড়ি হাতিয়ে নিতে সিন্ডিকেটের কারসাজি ধরা পড়ায় এনবিআর পরবর্তী নিলাম স্থগিত করেছিল।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিলাম সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি গাড়িগুলোর ই-নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম নিলামে সিন্ডিকেটের সদস্যরা নামেমাত্র দর দিয়ে পরবর্তী নিলামে গাড়ি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
আরও পড়ুন: রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধে মাঠ পর্যায়ে গোয়েন্দা জোরদার
কাস্টমস আইনের অনুযায়ী, নিলামের বেঁধে দেওয়া মূল্যের ৬০ শতাংশ পূর্ণ হতে হবে। প্রথম নিলামে শর্ত পূর্ণ না হলে দ্বিতীয় নিলামে প্রথম নিলামের চেয়ে বেশি দর দিলে পণ্য চালান খালাস দেওয়ার বিধান রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সিন্ডিকেট প্রথম নিলামে কম দর দিয়েছিল।
এর ফলে গত ১১ মার্চ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে মতামত চাওয়া হলে ২৪ মার্চ এনবিআর জানায়, গাড়ি নিলামের যাবতীয় কার্যক্রম স্থগিত থাকবে।
সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখে এনবিআরের চিঠি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে আসে।
এতে বলা হয়, দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে থাকা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা মূল্যবান ৩০টি গাড়ি বিকল্প উপায়ে নিষ্পত্তির সুযোগ থাকায় অর্থ বিভাগের সিদ্ধান্তে ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক গাড়িগুলো সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছে। নিলামের স্থায়ী আদেশ ২০২২-এর অনুচ্ছেদ ৭-এর (১)-এর ক্লজ(ট)-এর বিধান অনুযায়ী গাড়িগুলো সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরে হস্তান্তরের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে নির্দেশ দেয়া হলো।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিলাম শাখার কাগজ অনুযায়ী, গাড়িগুলোর মধ্যে টয়োটা ব্র্যান্ডের ল্যান্ড ক্রুজার ২৬টি এবং জাপানে তৈরি টয়োটা হ্যারিয়ার ৪টি রয়েছে। এগুলো আমদানি করেছিলেন সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি মোহাম্মদ সাদিক, ময়মনসিংহ-৭ আসনের সাবেক এমপি এ বি এম আনিসুজ্জামান, আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মজিবুর রহমান ও জান্নাত আরা হেনরী, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, সানজিদা খানম, এস এম কামাল হোসেন, মো. আসাদুজ্জামান, নাদিয়া বিনতে আমিন, মুহাম্মদ শাহজাহান ওমর, অনুপম শাহজাহান জয়, সাজ্জাদুল হাসান, মো. সাদ্দাম হোসেন (পাভেল), তারানা হালিম, সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নাসের শাহরিয়ার জাহেদী, আখতারউজ্জামান, মো. আবুল কালাম আজাদ, রুনু রেজা, মো. তৌহিদুজ্জামান, শাহ সারোয়ার কবীর, এস এ কে একরামুজ্জামান, এস এম আল মামুন, আবদুল মোতালেব, শাম্মী আহমেদ ও মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ।
এর মধ্যে ২০২৪ সালে জাপানে তৈরি ৩৩৪৬ সিসি ল্যান্ড ক্রুজার জেডএক্স মডেল ২৪টি রয়েছে। প্রতিটির সংরক্ষিত মূল্য ৯ কোটি ৬৭ লাখ ৩ হাজার ৮৯৯ টাকা। এছাড়া ২০২১ সালে জাপানে তৈরি ২৬৯৩ সিসি ল্যান্ড ক্রুজার টিএক্স মডেল ২টি আছে, যার সংরক্ষিত মূল্য যথাক্রমে ১ কোটি ৬২ লাখ ৭৩ হাজার ৮৪ টাকা এবং ১ কোটি ৩৭ লাখ ৯৬ হাজার ১২১ টাকা।
নিলাম ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ মো. এয়াকুব চৌধুরী বলেন, নিলামের আইন অনুসারে বেঁধে দেওয়া মূল্যের ৬০ শতাংশ পূরণ করতে হলে একেকটি গাড়িতে সাড়ে সাত কোটি টাকা মূল্য আসবে। কিন্তু ওই দামে গাড়িগুলো বিক্রি করা সম্ভব নয়। সরকারি দপ্তরে দেওয়ার ফলে গাড়িগুলোর সঠিক ব্যবহার হবে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপ-কমিশনার (নিলাম) মো. রাসেল আহমেদ বলেন, এমপিদের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা ৩০টি গাড়ি রাষ্ট্রায়ত্ত যানবাহন অধিদপ্তরে হস্তান্তরের চিঠি পেয়েছি। এসব গাড়ি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ব্যবহার হবে। কারসাজির মাধ্যমে সিন্ডিকেটের নিলাম নেওয়ার সুযোগ আর নেই। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে গাড়িগুলো প্রয়োজনীয় কাজ শেষে হস্তান্তর করা হবে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি