২৭ হাজার কোটি টাকায় কেনা হচ্ছে ভারতের রাফাল ধ্বংস করা সেই যুদ্ধবিমান

ছবি: সংগৃহীত
বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন ও জাতীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার লক্ষ্যে চীনের কাছ থেকে ২০টি জে-১০সি মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান কেনার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের পর বাংলাদেশই হতে যাচ্ছে এই অত্যাধুনিক প্ল্যাটফর্মের দ্বিতীয় ব্যবহারকারী দেশ।
চীনের শীর্ষ প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান চেংদু এভিয়েশনের তৈরি এই ৪.৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমানকে আন্তর্জাতিক মহলে ফ্রান্সের রাফাল যুদ্ধবিমানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে পাকিস্তান দাবি করে, তারা চীনের তৈরি জে-১০সি ব্যবহার করে ভারতের রাফাল যুদ্ধবিমানকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। এই দাবি আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী, প্রস্তাবিত চুক্তির আওতায় যুদ্ধবিমান, পাইলট ও কারিগরি প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি, পরিবহন, বীমা ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২২০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৭,০৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রতিটি জে-১০সি ফাইটার জেটের প্রাথমিক মূল্য ধরা হয়েছে ৬ কোটি ডলার। ফলে ২০টি যুদ্ধবিমানের মোট দাম দাঁড়ায় ১২০ কোটি ডলার বা প্রায় ১৪,৭৬০ কোটি টাকা। বাকি ১০০ কোটি ডলারের ব্যয় হবে প্রশিক্ষণ, যন্ত্রাংশ, পরিবহন, বীমা, ভ্যাট, কমিশন ও অবকাঠামো খাতে।
চুক্তিটি সরকার থেকে সরকারের (জি-টু-জি) ভিত্তিতে সম্পন্ন হবে। এতে যুদ্ধবিমানের সংরক্ষণ সহায়তা, প্রশিক্ষণ, খুচরা যন্ত্রাংশ ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। প্রকল্পের অর্থ ১০ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ২০৩৫-৩৬ অর্থবছর পর্যন্ত কিস্তিতে পরিশোধের শর্তে কার্যকর হবে। চূড়ান্ত মূল্য ও অর্থ পরিশোধের শর্ত (টার্মস অব পেমেন্ট) নির্ধারণে চীনা প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
চলতি বছরের মার্চে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরে যান। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, সফরে তিস্তা নদীর প্রকল্পে চীনের সহায়তা, মাল্টিপল রোল কমবেট এয়ারক্র্যাফট কেনা এবং বাংলাদেশের বন্দরগুলোর সঙ্গে চীনের কুনমিংয়ের বহুমাত্রিক সংযুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়।
আরও পড়ুন: সেনাপ্রধানের বক্তব্য বিকৃতি ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর বিবৃতি
এরপর গত এপ্রিল মাসে বিমান বাহিনীর প্রধানকে সভাপতি করে ১১ সদস্যের একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি যুদ্ধবিমান ক্রয়সংক্রান্ত খসড়া চুক্তিপত্র পর্যালোচনা, মূল্য নির্ধারণ ও দর-কষাকষির দায়িত্বে রয়েছে।
জে-১০সি যুদ্ধবিমান মূলত চীনের বিমানবাহিনীর ব্যবহৃত মডেলের রপ্তানি সংস্করণ। বাইই অ্যারোবেটিক টিমের বহরে যুক্ত এই জঙ্গিবিমান আন্তর্জাতিক এয়ারশোগুলোতেও অংশ নিয়েছে। ওয়াইইউ-২০ এরিয়াল ট্যাংকারের সহায়তায় এটি দীর্ঘপথ অতিক্রমে সক্ষম এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও উচ্চগতির পারফরম্যান্সের জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে সমাদৃত।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস)-এর প্রেসিডেন্ট ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল এ এন এম মনিরুজ্জামান (অব.) বলেন, “বিমান বাহিনীর দীর্ঘদিন ধরেই আধুনিক যুদ্ধবিমানের প্রয়োজন ছিল। এই উদ্যোগ সেই ঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে।” তবে তিনি ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনার পরামর্শ দিয়ে বলেন, “বর্তমানে বৈশ্বিক রাজনীতিতে স্পষ্ট বলয় দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে টানাপোড়েন চলছে, তা আমাদের মতো দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কৌশলগত প্রভাব বিশ্লেষণ জরুরি।”
বর্তমানে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর (বিএএফ) বহরে রয়েছে মোট ২১২টি এয়ারক্রাফট, যার মধ্যে ৪৪টি ফাইটার জেট। এর মধ্যে ৩৬টি চীনের তৈরি পুরনো মডেলের এফ-৭, ৮টি রাশিয়ান মিগ-২৯বি ও ইয়াক-১৩০ লাইট অ্যাটাক বিমান রয়েছে। জে-১০সি যুক্ত হলে তা বিমান বাহিনীর আধুনিকায়নে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হবে।
বিএএফের প্রধান এয়ার মার্শাল হাসান মাহমুদ খান বলেন, “দেশের আকাশ প্রতিরক্ষা সক্ষমতা আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আধুনিক যুদ্ধবিমান এবং অ্যাটাক হেলিকপ্টার অর্জনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।”
বাংলাদেশ ও চীনের দীর্ঘদিনের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ধারাবাহিকতায়, এই জে-১০সি ক্রয় নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ২০২২ সালে পাকিস্তান ২৫টি জে-১০সি যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করেছিল, যা দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের সামরিক প্রভাবকে শক্তিশালী করেছে। এবার বাংলাদেশও সেই কৌশলগত পরিসরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি/এনডি