News Bangladesh

|| নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৩:০৮, ৭ আগস্ট ২০১৫
আপডেট: ০৩:৪৮, ৫ আগস্ট ২০২০

শত বছর পেরিয়ে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর

শত বছর পেরিয়ে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর

রাজশাহী: শত বছর পেরিয়েছে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। ১০৫ বছরে পা রাখতে যাওয়া দেশের প্রথম ও প্রাচীন এ জাদুঘরটির সৌন্দর্য বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। বর্তমানে এ জাদুঘরে রয়েছে প্রায় ১১ হাজার প্রত্ন নিদর্শন। ১৯১০ সালে কুমার শরৎকুমার রায়ের প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরটি এখন বঙ্গীয় শিল্পকলার সবচেয়ে সমৃদ্ধ সংগ্রাহশালা।

বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত ‘গৌড়রাজমালা’ পড়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমিতির কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “গহনের মধ্যে অদৃশ্য গৌড় পুনরাবৃত্তের লুপ্তপ্রায় রথচক্ররেখার অনুসরণ করিয়া আপনারা আমাদের দেশের ইতিহাসের যে সুপ্রশস্ত রাজপথ উৎঘাটনে ব্রতী হইয়াছেন, আপনাদের সে উদ্যোগ সার্থক হইল।”

বাংলাদেশের বিস্মৃত ও লুপ্তপ্রায় ইতিহাসের উপাদান সংকলনের আশায় বরেন্দ্রভূমিতে ধারাবাহিকভাবে তথ্যানুসন্ধানের জন্য গত শতাব্দীর প্রথম দশকে গঠিত হয় বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি। এ ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের জাদুঘর। মহৎ ও কালজয়ী এ প্রচেষ্টার পেছনে কুমার শরৎকুমার রায়ের ব্যক্তিগত অবদান অপরিসীম।

তার অদম্য জ্ঞান পিপাসা এবং পুরাতত্ত্বের প্রতি গভীর অনুরাগ এ প্রচেষ্টাকে সার্থক করে। উত্তরাঞ্চলে ঐতিহাসিক একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ছাত্রাবস্থাতেই যে তার ছিল, তা জানা যায় তার গৃহশিক্ষকের বিবরণে। তার গৃহশিক্ষক রামেন্দুসুন্দর ত্রিবেদী ‘ঐতরেয় ব্রাক্ষণ’ গ্রন্থের ভুমিকায় বলেন, “দীঘাপতিয়া রাজবংশের উজ্জ্বল প্রদীপ শ্রীমান কুমার শরৎকুমার রায় যখন আমার নিকট পদার্থবিদ্যা পড়িয়া এমএ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলেন, আমি তখন পদার্থবিদ্যার সীমা ছাড়াইয়া মাঝে মাঝে অন্যান্য কথা পাড়িতাম।”

ত্রিবেদী বলেন, “ভারতবর্ষের প্রাচীনতম শাস্ত্র গ্রন্থসমূহের বাঙ্গালা অনুবাদ প্রকাশ করিয়া এই সন্ধান কার্য্যে সাহায্য করা উচিত, এই কল্পনাও সেই সময় অঙ্কুরিত হইয়াছিলো।”

এরপর এমএ পাশ করে ১৯০০ সালে তিনি যখন ইউরোপে যান এবং বিভিন্ন প্রাচীন নগরীর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রত্যক্ষ করেন। বস্তুত তখন থেকেই তার মনে নিজের দেশের প্রাচীন সভ্যতা এবং ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ইচ্ছা সুদৃঢ় হয়। ইউরোপ থেকে প্রত্যাবর্তনের পরপরই তিনি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে সচেষ্ট হন।

এ ব্যাপারে তিনি প্রথম থেকেই অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং রমাপ্রসাদ চন্দ্রের সহায়তা লাভ করেন। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের আদি সূচনা ঘটে ১৯১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ১৯১৪ সালে এ সমিতিকে ১৮৬০ সালের ভারতীয় সমিতি আইন অনুযায়ী নিবন্ধন করা হয়।

এ দেশের তিনজন কৃতি সন্তান দীঘাপতিয়ার রাজবংশজাত দয়ারামপুরের জমিদার বিদ্যোৎসাহী কুমার শরৎকুমার রায়, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও আইনজীবি অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং খ্যাতনামা নৃতত্ত্ব ও শিক্ষাবিদ রমাপ্রসাদ চন্দ্র এ অনুসন্ধান সমিতি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারা অনুসন্ধান সমিতিতে যথাক্রমে ছিলেন সভাপতি, পরিচালক এবং সম্পাদক।

বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি গঠনের পর থেকে এর সদস্যরা বরেন্দ্র প্রত্নতত্ত্ব চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। তারা প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহ করেছিলেন এ আশায় যে, এগুলো যথাযথভাবে গবেষণা করা হলে বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।

এ উদ্দেশ্যে বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির পক্ষে কুমার শরৎকুমার রায়, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রমাপ্রসাদ চন্দ্র, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রামকমল সিংহ ও কলিকাতা জাদুঘরের রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে গঠিত অনুসন্ধানী দল রাজশাহী জেলার দেওপাড়া, চব্বিশনগর, মাডৈল, কুমারপুর, বিজয়নগর, খেতুর, জগপুর, মালঞ্চ প্রভৃতি স্থানে অনুসন্ধান চালিয়ে বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য পুরাকীর্তি সংগ্রহ করেন।

অনুসন্ধানী দলের এ সংগ্রহ রাজশাহী নিয়ে আসার পর তা সংরক্ষণ করা এক বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সংগৃহীত প্রত্নসামগ্রী প্রাথমিকভাবে কুমার শরৎকুমার রায়ের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাজা প্রমদানাথ রায়ের রাজশাহীর বাড়ির উঠানে (পুরাতন বিভাগীয় কমিশনার ভবন) রাখা হয়। পরে রাজশাহী পাবলিক লাইব্রেরীর নিচতলায় একটি কক্ষে তা স্থানান্তরিত করা হয়।

ক্রমান্বয়ে সংগ্রহের সংখ্যা বাড়তে থাকলে পাবলিক লাইব্রেরির বরাদ্দকৃত ঘরে সংকুলান হচ্ছিল না। তখন নিজস্ব ভবনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং একটি জাদুঘর ভবন প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

কুমার শরৎকুমার রায় নিজ ব্যয়ে রাজশাহী শহরে এই জাদুঘর ভবনটি নির্মাণ করেন। নবনির্মিত ভবনটির দায়িত্বভার রেজিস্ট্রিকৃত দলিলের মাধ্যমে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি ট্রাস্টি বোর্ডের উপর অর্পণ করা হয়। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা হলেন কুমার শরৎকুমার রায়, কুমার প্রতিভানাথ রায়, মহেন্দ্রকুমার সাহা চৌধুরী, রমাপ্রসাদ চন্দ্র এবং অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়।

১৯১৬ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলার তদানীন্তন গভর্নর লর্ড কারমাইকেল এই ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯১৯ সালের ২৭ নভেম্বর লর্ড রোনাল্ডস এর দ্বারোন্মোচন করেন। পাবলিক লাইব্রেরী থেকে সব সংগ্রহ এই নতুন ভবনে নিয়ে আসা হয়। এরপর জাদুঘরের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ১৯৩৭ সালের ৬ নভেম্বর প্রতিষ্ঠা করা হয় ব্যবস্থাপনা কমিটি।

ওই তারিখ থেকে জাদুঘরটি একটি আধা সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হতে থাকে এবং পদাধিকার বলে এর সভাপতি নিযুক্ত তৎকালীন জেলা প্রশাসক।

প্রাচীন গৌড়ীয় স্থাপত্যশৈলীর ধারায় নির্মিত এ জাদুঘর অল্পদিনের মধ্যেই বঙ্গীয় শিল্পকলার সমৃদ্ধ ভাণ্ডার হিসেবে সারাবিশ্বে খ্যাতিলাভ করে। সংগ্রহের গুণগত ও পরিমানগত সমৃদ্ধির কারণে। প্রায় সাড়ে ১০ হাজার প্রত্ননিদর্শনের মধ্যে এখানে রয়েছে ভাস্কর্য শিল্প, বিভিন্ন মুদ্রা, শিলালেখ, তাম্রশাসন, পোড়ামাটির ফলক ও অন্যান্য মৃৎশিল্প।

বরেন্দ্র জাদুঘরের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক সুলতান আহমেদ নিউজবাংলাদেশকে বলেন, “এ জাদুঘরে বর্তমানে প্রায় ১১ হাজারের অধিক প্রত্ননিদর্শন রয়েছে। এ সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বঙ্গীয় শিল্পকলার সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন সংগ্রহশালা হিসেবে বরেন্দ্র জাদুঘর এখন সমৃদ্ধ।”

নিউজবাংলাদেশ.কম/এটিএস/এএইচকে

নিউজবাংলাদেশ.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়