News Bangladesh

আসাদুল হক খোকন, নিউজ এডিটর || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৭:৪২, ১ মার্চ ২০২৫
আপডেট: ১৭:৩৩, ২ মার্চ ২০২৫

দ্বিতীয় রিপাবলিক কি ও কেন?

দ্বিতীয় রিপাবলিক কি ও কেন?

ছবি: সংগৃহীত

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রায় আট মাস পর গঠিত হলো তরুণদের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল। যার নাম জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির মূল লক্ষ্য হিসেবে এর নেতারা বলেছেন, দেশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ (Second Republic) প্রতিষ্ঠা করার কথা। গত শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) নতুন এ দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে একই কথা জানিয়েছেন দলটির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম। 

অনেকে দ্বিতীয় রিপাবলিক গঠন নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছেন। কেউ কেউ এই বিষয়টি সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। অনেকে বলেছেন, এমন শব্দ তাদের কাছে নতুন। জানেন না এর মানে কি? 

প্রকৃত অর্থেই দ্বিতীয় রিপাবলিক বলতে তরুণ নেতারা কি বোঝাতে চাইছেন, সেটি অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। তাছাড়া অনেকের কাছে এই বিষয়টি একেবারেই নতুন। তবে মনে রাখতে হবে, জনগণের ঘাড়ে চেপে বসা স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারকে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য করেছে এই তরুণ প্রজন্ম। যা দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে শত চেষ্টা করেও দেশের কোনো রাজনৈতিক দল সর্বশক্তি দিয়েও পারেনি। তারা দেশটিকে নতুনভাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখবেন এটি স্বাভাবিক।

অন্যদিকে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পর সেই তরুণরা দেশে পরিচালায় নের্তৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি বাংলা ভাষার অভিধানে যোগ করেছে বেশ কিছু দুর্দান্ত শব্দ। সেসব শব্দ আমাদের কাছে নতুন মনে হলেও গণঅভ্যুথ্থানে শক্তি যোগানো ও দেশের সার্বিক কল্যাণ সাধনে গুরুত্ব বহন করে।

‘সংস্কার’ শব্দটি এর মধ্যে অন্যতম। যা আগে কখনো এভাবে চর্চা হয়নি। যে কারণে অনেকের কাছেই প্রথমদিকে তা অবোধ্য বা বিস্ময়কর ছিল। কিন্তু এখন দিন বদলের সাথে সাথে সংস্কার একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ শব্দে পরিণত হয়েছে। যাকে বাদ দিয়ে- নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা চিন্তাও করা যায় না। ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ ও ঠিক তেমনি। এর সঠিক প্রয়োগ হলে নিশ্চিত সুফল পাবে দেশ ও এর জনগণ।

এবার দ্বিতীয় রিপাবলিক বলতে তরুণরা কি বলতে চাইছেন চলুন তা বুঝতে চেষ্টা করা যাক।

দ্বিতীয় রিপাব্লিক ধারণাটি ফ্রান্সের ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। পোল্যান্ড, কোস্টারিকাসহ আরও কয়েকটি দেশের ইতিহাসের সঙ্গেও মিশে আছে এটি। এটি এমন একটি রাজনৈতিক ধারণা, যা বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সার্বিকভাবে এমন ধারণায় কোনো দেশে পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা শাসনকাঠামো গ্রহণ করাকে বোঝায়। বিপ্লব, অভ্যুত্থানসহ নানাভাবেই আসতে পারে এমন পরিবর্তন।

অন্যদিকে বিষয়টিকে পরিস্কার করে ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ বলতে ‘এ ভূখণ্ডের মানুষের সব লড়াই একীভূত করে মানুষের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে সংবিধান ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনকে বুঝিয়েছে বলে জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি।

দ্বিতীয় রিপাবলিক বুঝতে হলে পড়া দরকার ফ্রান্সের ইতিহাস। তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ফ্রান্সে এখন পঞ্চম রিপাবলিক পিরিয়ড বা সময় চলমান। 
 
বিষয়টি নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করা যেতে পারে। এজন্য ধারাবাহিকভাবে ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন তুলে ধরছি। এই পরিবর্তন ধাপগুলো অনুসরণ করতে থাকলেই পরিস্কার হয়ে যাবে দ্বিতীয় রিপাবলিক কি? কেন এই পরিবর্তন আবশ্যক বলে মনে করছে তরুণ প্রজন্ম।

ক. ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ফ্রান্স ছিলো রাজ শাসনের রাষ্ট্র। ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সংঘটিত হয় ফরাসি বিপ্লব। বিপ্লবে আম জনতা বিজয় লাভ করে। ফলে রাজশাসন নির্বাসিত হয়। বিপ্লব চলমান থাকা অবস্থায় ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সকে প্রথম রিপাবলিক বা জনতার শাসনের রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে এ পর্ব বেশি  দিন স্থায়ী হয় নি। প্রথম রিপাবলিকের মেয়াদ ছিলো ১৭৯২ থেকে ১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দ।  

খ. ১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে দেশটি আবার স্বৈরতান্ত্রিক রাজ শাসনের কবলে পড়ে। দেশটিতে ১৮০৪ থেকে ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এক অস্থিতিশীল রাজতন্ত্র ঘুরপাক খেতে থাকে।

১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে দেশটি স্বৈরশাসনের রাহুমুক্ত হয়।

আরও পড়ুুন: আত্মপ্রকাশ করল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)

১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে দেশটিকে দ্বিতীয় রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা  করা  হয়। এ পর্ব  স্থায়ী হয় ১৮৪৮ থেকে ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। 

১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে দেশটি আবার স্বৈরশাসনের কবলে পড়ে। স্বৈরশাসনের এ পর্ব  ১৮৫২ থেকে ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত  চলে। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে দেশটিতে স্বৈর শাসনের পতন ঘটে।
 
গ. ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে দেশটিকে তৃতীয় রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ পর্ব  চলে ১৮৭০ থেকে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।  

১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানি ফ্রান্স দখল করে। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দেশটি জার্মানির দখলে থাকে। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানির দখলমুক্ত হয়। তবে ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দেশটি শাসন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকারের  চেয়ারম্যান ছিলেন জেনারেল  দ্যাগল। তিনি ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজনীতি থেকে বিদায় নেন।

ঘ. ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সকে চতুর্থ রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ পর্ব  ১৯৫৮ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে দেশটিতে গৃহযুদ্ধের  আশংকা  দেখা  দেয়। 

দেশকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচাতে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে জেনারেল  দ্যাগল আবার শাসনভার গ্রহণ করেন। এ পর্বের সূচনাতে ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সকে পঞ্চম রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। জেনারেল দ্যাগল ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। তার হাত ধরে নবযাত্রা শুরু করা ফ্রান্সে এখন পঞ্চম রিপাবলিক পিরিয়ড চলমান। 

দেশটি এখন পৃথিবীর অন্যতম সেরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গুলোর  একটি। ফ্রান্স এখন পৃথিবীর অন্যতম সেরা কল্যাণ রাষ্ট্র। 

সুতরাং বাংলাদেশে নতুন করে দ্বিতীয় রিপাবলিক ঘোষণার মানে হলো, অতীতের দুর্নীতিগ্রস্ত ও জরাজীর্ণ রাষ্ট্র কাঠামোকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা সাজানো। নতুন করে শপথ নিয়ে যাত্রা পুরো রাষ্ট্র কাঠামোকে নতুনভাবে সাজানো, তা বাস্তবায়নে সার্বক্ষণিক নিরলস কাজ করে যাওয়া এবং এই ধারা অব্যহত রাখার পথ তৈরি করা।

যদি বিস্তারিত আলোচনা থেকে এ বিষয় স্পষ্ট হয় যে, তরুণদের এই উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে মহৎ, দেশ ও জনগণের জন্য কল্যাণকর এবং জনসাধারণের আকাঙ্খার জায়গাও ঠিক এটিই। তাহলে দেশের সামগ্রিক পরিবর্ন ও উন্নয়নে নতুন এই  দ্বিতীয় রিপাব্লিক পদ্ধতি কেন প্রয়োজন তার কারণ খোঁজার কোনো যুক্তি আর অবশিষ্ঠ থাকে না।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক  

নিউজবাংলাদেশ.কম/এনডি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়