জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ৮ দফা অঙ্গীকারনামার চূড়ান্ত খসড়া
ফাইল ছবি
দেশের সব রাজনৈতিক দলের কাছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর একটি সমন্বিত খসড়া পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
শনিবার (১৬ আগস্ট) সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে খসড়াটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়।
এই খসড়ার সঙ্গে আটটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকারনামাও সংযুক্ত করা হয়েছে, যা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত জনগণের ইচ্ছাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য প্রণীত হয়েছে।
কমিশন ২০ আগস্ট, ২০২৫ বিকেল ৪টার মধ্যে দলগুলোর কাছ থেকে খসড়ার ভাষা, শব্দ বা বাক্যগঠন সম্পর্কিত যেকোনো মন্তব্য বা পরামর্শ জমা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এই সনদকে একটি 'নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দলিল' হিসেবে বর্ণনা করেছে, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে সম্মান জানিয়ে প্রণীত হয়েছে।
অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, এই সনদের বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশগুলো সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্ন কিছু থাকলে এই সনদের বিধানগুলোই প্রাধান্য পাবে।
সনদের খসড়ায় বলা হয়েছে যে এর প্রতিটি বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক এবং আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য হবে। এর বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা বা জারির কর্তৃত্ব নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। কোনো ব্যাখ্যা সংক্রান্ত প্রশ্ন উঠলে তার চূড়ান্ত মীমাংসার ভার ন্যস্ত থাকবে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ওপর।
জুলাই জাতীয় সনদের খসড়াটি মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত:
- প্রথম অংশে সনদের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পটভূমি বর্ণনা করা হয়েছে।
- দ্বিতীয় অংশে রয়েছে ছয়টি সংস্কার কমিশনের (সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ) ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব, যেগুলোর ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। কোন কোন দল কোন প্রস্তাবে একমত হয়েছে এবং কার ভিন্নমত রয়েছে, তাও এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
- তৃতীয় অংশে রয়েছে সনদ বাস্তবায়নের জন্য প্রণীত আট দফা অঙ্গীকারনামা।
এর আগে গত ২৯ জুলাই কমিশন দলগুলোকে সনদের একটি প্রাথমিক খসড়া দিয়েছিল, যার ওপর ভিত্তি করে প্রাপ্ত মতামতের সমন্বয়ে এই নতুন খসড়াটি তৈরি করা হয়েছে।
ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে যে, সনদের বিষয়বস্তু নিয়ে ঐকমত্য হলেও এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে। বিএনপি অঙ্গীকারনামা স্বাক্ষরে একমত হলেও জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র মতো কিছু দল মনে করে, কেবল অঙ্গীকারই যথেষ্ট নয়; সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়া এবং একটি সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করা জরুরি।
দলগুলোর এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে গণভোট, সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ (রেফারেন্স), বিশেষ পরিস্থিতির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা এবং লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, কমিশন আশা করছে দলগুলো দ্রুত তাদের ভাষাগত পরামর্শ দেবে। এর পাশাপাশি, বাস্তবায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে আগামী সপ্তাহে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
কমিশনের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার জানান যে, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গেও সনদ বাস্তবায়নে আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরির সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
আরও পড়ুন: জুলাই সনদে আইনি সুরক্ষা, ভোটের আগে সুপারিশ বাস্তবায়ন
খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত আট দফা অঙ্গীকারনামাগুলো হলো:
১. ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে অর্জিত জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
২. সনদের সকল বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা এবং বিদ্যমান আইনের ওপর এর প্রাধান্য নিশ্চিত করা।
৩. সনদের ব্যাখ্যার চূড়ান্ত এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ওপর ন্যস্ত করা।
৪. সনদের সাংবিধানিক ও আইনগত বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা এবং কোনো আদালতে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন না তোলার বিধান রাখা।
৫. সনদে উল্লেখিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান ও আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন বা নতুন আইন প্রণয়ন করা।
৬. ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া।
৭. গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা।
৮. সনদের যে প্রস্তাবগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা।
এই সনদ চূড়ান্ত রূপ পাবে যখন সব রাজনৈতিক পক্ষ এর বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিষয়ে একমত হয়ে স্বাক্ষর করবে। এটি দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক, আইনি এবং শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি








