গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময়ের চুক্তিকে স্বাগত জানালেন জাতিসংঘ মহাসচিব

ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ দুই বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী গাজা যুদ্ধের অবসানে ঐতিহাসিক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাস বুধবার (৮ অক্টোবর) প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময় চুক্তিতে পৌঁছেছে। এটি ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০ দফা গাজা শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যাল-এ এই ‘ঐতিহাসিক শান্তি সূচনা’ ঘোষণা করে লিখেছেন, আমি গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করছি, ইসরায়েল ও হামাস উভয়েই আমাদের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে স্বাক্ষর করেছে। খুব শিগগিরই সব বন্দি মুক্তি পাবে এবং ইসরায়েল সম্মত সীমারেখায় সেনা সরিয়ে নেবে।
তিনি কাতার, মিশর ও তুরস্কের মধ্যস্থতাকারীদের ধন্যবাদ জানিয়ে এটিকে ‘এক শক্তিশালী, স্থায়ী ও চিরন্তন শান্তির প্রথম পদক্ষেপ’ বলে অভিহিত করেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন।
আনাদোলু এজেন্সির খবরে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময়ের বিষয়ে ঘোষিত চুক্তিকে স্বাগত জানাই। এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়েছে।
তিনি যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, মিসর ও তুরস্কের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে চুক্তির শর্তাবলি পুরোপুরি মেনে চলতে অনুরোধ করেন।
গুতেরেস এটিকে ‘দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দিকে এক ঐতিহাসিক সুযোগ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন, ‘এখনকার ঝুঁকির মাত্রা কখনো এত বেশি ছিল না। তাই এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।’
চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় মিসরের শার্ম এল শেখে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও তুরস্কের প্রতিনিধিরা আলোচনায় যুক্ত ছিলেন। প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিস্তারিত সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়নি।
তবে জানা গেছে, ইসরায়েলি সরকারের আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্দি বিনিময় শুরু হবে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, প্রক্রিয়াটি শনিবার থেকেই শুরু হতে পারে।
এক ফিলিস্তিনি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক ২৫০ ফিলিস্তিনি বন্দি এবং গাজার ১ হাজার ৭০০ বাসিন্দাকে মুক্তি দেওয়া হবে।
হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রথম ধাপে হামাস ২০ জন জীবিত বন্দিকে মুক্তি দেবে।
এপিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, হামাস এই সপ্তাহান্তে জীবিত থাকা ২০ জন জিম্মিকে মুক্তি দেবে এবং নিহত জিম্মিদের দেহাবশেষ পরবর্তী ধাপে ফেরত দেওয়া হবে।
ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার: চুক্তি অনুযায়ী, ইসরায়েলি সেনারা প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা থেকে সরে আসবে।
মানবিক সহায়তা: এক জ্যেষ্ঠ ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বিবিসিকে জানিয়েছেন, ইসরায়েল প্রতিদিন গাজায় ৪০০টি ত্রাণ ট্রাক প্রবেশ করতে দেবে এবং পরে ধাপে ধাপে এই সংখ্যা বাড়ানো হবে।
আরও পড়ুন: গাজা যুদ্ধবিরতিতে ঐকমত্যে ইসরায়েল–হামাস: ট্রাম্প
হামাস এক বিবৃতিতে চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে, যার মধ্যে ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহার ও বন্দি-বন্দি বিনিময় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তারা ট্রাম্প ও অন্যান্য গ্যারান্টি রাষ্ট্রগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়েছে যাতে ইসরায়েল সম্পূর্ণভাবে চুক্তি বাস্তবায়ন করে।
হামাস জানিয়েছে, তারা ইসরায়েলে আটক ফিলিস্তিনি বন্দিদের একটি তালিকা জমা দিয়েছে, যার মধ্যে ফাতাহ নেতা মারওয়ান বারঘুতি ও পপুলার ফ্রন্টের প্রধান আহমেদ সাদাত-এর মতো বন্দিরাও রয়েছেন।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তার সহায়তায় আমরা আমাদের সব নাগরিককে ঘরে ফিরিয়ে আনব।’
তিনি বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকে আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের ঘোষণা দেন।
যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানিয়ে নেতানিয়াহু বলেছেন, আমাদের জিম্মিদের মুক্ত করতে তাদের প্রতিশ্রুতি এক পবিত্র দায়িত্ব। তিনি ট্রাম্পকে ইসরায়েলি পার্লামেন্ট ‘কনেসেট’-এ বক্তব্য দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা শান্তি পরিকল্পনার ওপর ভোট দেবে। যদি তখন ইসরায়েল সম্মতি দেয়, তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনারা সরে যাবে। ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি বন্দীরা মুক্তি পেতে শুরু করার সময় মধ্যপ্রাচ্যে ভ্রমণ করতে পারেন এবং সম্ভবত শনিবারই মিশর সফরে যেতে পারেন।
কাতার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি জানিয়েছেন, এই চুক্তি ‘যুদ্ধের অবসান, ইসরায়েলি জিম্মি ও ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি এবং গাজায় ত্রাণ প্রবেশের’ পথ খুলে দেবে।
জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস বলেন, সব বন্দিকে মর্যাদার সঙ্গে মুক্তি দিতে হবে এবং একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে হবে। যুদ্ধ এখনই এবং চিরতরে থামাতে হবে। গাজায় মানবিক সহায়তা ও বাণিজ্যিক পণ্য প্রবেশে অবাধ সুযোগ দিতে হবে। এই অবর্ণনীয় কষ্টের অবসান ঘটাতে হবে।’ তিনি জানান, জাতিসংঘ এই চুক্তি বাস্তবায়নে পূর্ণ সহায়তা দেবে এবং গাজায় টেকসই মানবিক সহায়তা, পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠন কার্যক্রম আরও জোরদার করবে।
এই চুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এখনো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় অনিষ্পন্ন—বিশেষ করে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা, যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা প্রশাসন এবং হামাসের ভবিষ্যৎ ভূমিকা।
হামাসের ভূমিকা: হামাস ইতোমধ্যে জানিয়েছে, তারা অস্ত্র ত্যাগের কোনো শর্ত মেনে নেবে না, যতক্ষণ ইসরায়েল দখল অব্যাহত রাখে। তারা কেবলমাত্র একটি ফিলিস্তিনি কারিগরি সরকার গঠনে রাজি, যা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও আরব-মুসলিম দেশগুলোর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে।
স্থায়ী সমাধান: আরব দেশগুলো জানিয়েছে, ট্রাম্পের পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপে যদি স্থায়ী শান্তি আসে, তবে তা একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের পথে নিয়ে যেতে হবে। তবে নেতানিয়াহু ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি কখনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের অনুমতি দেবেন না।
সংঘাতের তীব্রতা: যুদ্ধবিরতি ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান গাজা সিটিতে হামলা চালায়। তবে গাজা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় ৮ জন নিহত হয়েছেন—যা গত কয়েক সপ্তাহের তুলনায় সবচেয়ে কম।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায় ইসরায়েলে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে বন্দি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। ইসরায়েলি প্রতিশোধমূলক অভিযানে গাজায় এখন পর্যন্ত ৬৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং অঞ্চলটির বেশিরভাগ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ও জাতিসংঘের তদন্তকারীরা ইসরায়েলের এই অভিযানকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, যদিও ইসরায়েল তা প্রত্যাখ্যান করে এটিকে আত্মরক্ষামূলক অভিযান বলেছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে এবং ‘যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে’। সেনাপ্রধান আইয়াল জামির বাহিনীকে বন্দি উদ্ধারের অভিযানের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। ট্রাম্প এই চুক্তিকে ‘বিশ্বের জন্য এক মহান দিন’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে, দীর্ঘ দুই বছর ধরে চলা গাজা যুদ্ধের অবসান ঘটবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে।
সূত্র: রয়টার্স, আল-জাজিরা, বিবিসি, আনাদোলু এজেন্সি
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি