মেহেদির রঙে বিপ্লবের আগুন: রাজপথে লামিয়া

ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ সালের জুন-জুলাই মাসজুড়ে যে ছাত্র-জনতার গণজাগরণে বাংলাদেশ রাষ্ট্র কাঠামোতে এক নতুন মোড় নেয়, সেই ঐতিহাসিক ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’-এর পেছনের প্রধান সংগঠকদের একজন হলেন লামিয়া ইসলাম। রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক, রাজনৈতিক সচেতনতা ও সাহসী ভূমিকার জন্য ইতোমধ্যে তরুণ সমাজে এক অনুপ্রেরণার নাম হয়ে উঠেছেন তিনি।
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নরত লামিয়া ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি সচেতন।
তার মতে, এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার শোষণ সাংবিধানিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকার এখন আর জনগণের সেবক নয়, বরং শোষক। তাই জনগণের রাষ্ট্র গড়ার জন্য রাজনীতিতে নেমেছি। চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদী নিপীড়নের সময়েও পিছিয়ে না থেকে মাঠে নেমে দাঁড়ানোর সাহস লামিয়া পেয়েছেন তাঁর আদর্শিক জেদ ও রাজনৈতিক অধ্যবসায় থেকে।
২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকেই লামিয়া সক্রিয়ভাবে যুক্ত। রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলনের সদস্য হিসেবে তিনি বহু আগে থেকেই আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্রজোটগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মসূচি চালিয়ে আসছিলেন।
তার ভাষায়, আমাদের ঐক্যই আওয়ামী জাহেলিয়াত থেকে মুক্তির পথ। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান ছিল এই ঐক্যের ফল।
১২ জুলাই ২০২৪, লামিয়ার বিয়ের দিন। তারও আগে শপিং ব্যাগ হাতে মিছিল করেছেন, ব্যারিকেডে ছিলেন। বিয়ের ঠিক দুই দিন বিরতি নিয়ে তিনি আবার আন্দোলনের মাঠে ফিরে আসেন।
বিয়ের মেহেদি তখনও রঙিন। অথচ আমি প্ল্যাকার্ড হাতে টিয়ারশেল খাচ্ছি, বলেন লামিয়া। এই অংশগ্রহণের জন্য তাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে মিথ্যা অজুহাত দিয়ে বের হতে হতো, তবে তিনি পেয়েছেন তার স্বামীর পূর্ণ সমর্থন।
আন্দোলনের কঠিন সময়ে যখন ছাত্রদের মোবাইল ফোন তল্লাশি করে পুলিশ চিহ্নিত করত, তখন লামিয়া এক কৌশল অবলম্বন করেন। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ফোন ফ্ল্যাশ দিয়ে বের হতেন যাতে কেউ তাকে রেকর্ড করতে না পারে। পাশাপাশি একটা কাগজে নিজের নাম, মায়ের ও স্বামীর ফোন নম্বর ও ঠিকানা লিখে রাখতেন, যদি গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকেন তবে যেন তার মৃতদেহ সনাক্ত করা যায়।
আরও পড়ুন: নারীদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকায় বেগবান হয় জুলাই আন্দোলন: আলী রীয়াজ
২ আগস্ট ২০২৪ শাহবাগে এক সহিংসতা চলাকালীন গুলির মুখে পড়েন লামিয়া।
আমার চোখের সামনে দু’জন রাস্তায় পড়ে যান। তখনই মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখা হয়ে যায়, বলেন তিনি। এই দিনটি তার মানসপটে অমোচনীয়ভাবে গেঁথে আছে।
জুলাই আন্দোলন সম্পর্কে লামিয়া বলেন, এটা ছিল আমাদের ক্ষোভ ও ভালোবাসার সম্মিলিত বিস্ফোরণ। আমরা শুধু মাঠে থেকেছি, আর মানুষ নিজেই রাস্তায় নেমে এসেছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্যে দীর্ঘদিনের সংগঠনী অভিজ্ঞতা তাকে নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করেছে।
তার কথায়, আপনি সাহস করে দাঁড়ালে দেখবেন, পাশে আরও হাজারো মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তীকালে লামিয়া ও তার সংগঠন রাষ্ট্র সংস্কারের বাস্তবায়ন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, এমন রাষ্ট্র চাই, যেখানে সরকার আইনের ঊর্ধ্বে নয়; যেখানে নীতিনির্ধারণ জনস্বার্থে হবে; কর আদায় মানেই জনগণের সেবা নিশ্চিত করা হবে।
তিনি মনে করেন, ক্ষমতা কোন ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়—হবে সাংবিধানিক ও নৈতিকভাবে বিকেন্দ্রীভূত।
গণঅভ্যুত্থানের একবছর পরও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আমূল সংস্কার দৃশ্যমান নয় বলে হতাশ লামিয়া।
তিনি বলেন, জুলাইয়ের আহতদের চিকিৎসা, ফ্যাসিবাদের বিচার ও সংবিধান সংস্কার—এই তিনটিই এখন জনগণের প্রধান দাবি। সরকার যদি সত্যিই জনগণের হয়, তবে তাদের এসব প্রশ্নে জবাবদিহি করতে হবে। ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা না হলে, এই আন্দোলনের আত্মত্যাগ পূর্ণ মর্যাদা পাবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
লামিয়া ইসলাম এখন শুধুই একজন আন্দোলনকারী নন; তিনি হয়ে উঠেছেন নতুন প্রজন্মের কাছে প্রতিরোধ, দায়বদ্ধতা ও নেতৃত্বের প্রতীক। তিনি রাজনীতিকে কেবল পদ-পদবির প্রশ্নে দেখেন না, বরং তা দেখেন রাষ্ট্রের কাঠামো বদলের সংগ্রাম হিসেবে। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব যেমন তার জীবনে গভীর ছাপ রেখে গেছে, তেমনি তার নেতৃত্ব ও আদর্শ এই বিপ্লবকে দিয়েছে হৃদয়।
“মুক্তির নেশা আপনার সামনে সবকিছু তুচ্ছ করে তুলবে”—এই কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার রাজপথে ফেরার অমোঘ টান।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি