‘মেগাথার্স্ট’ ফল্টে বাড়ছে চাপ, বিপর্যয়ের শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলোকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আগাম সংকেত হিসেবে দেখছেন দেশি-বিদেশি ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ভূগর্ভে চাপ ক্রমেই বাড়ছে এবং গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় থাকা ‘মেগাথার্স্ট’ ফল্ট থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টির আশঙ্কা এখন আর কেবল তাত্ত্বিক নয়, বরং বাস্তব ঝুঁকি। সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাবডাকশন জোনে গত ৮০০ থেকে ১০০০ বছরের সঞ্চিত শক্তি এখনও মুক্ত হয়নি—যা বিশেষজ্ঞদের মতে সবচেয়ে উদ্বেগজনক সতর্কসংকেত।

শনিবার (৩০ নভেম্বর) রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে অনুষ্ঠিত ‘আর্থকুয়েক অ্যাওয়ারনেস, সেফটি প্রটোকলস অ্যান্ড ইমার্জেন্সি প্রিপেয়ার্ডনেস’ শীর্ষক সেমিনারে এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন দেশি-বিদেশি ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ, স্থপতি, প্রকৌশলী, রিয়েল এস্টেট উদ্যোক্তা, নীতিনির্ধারক এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা। অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে জেসিএক্স ডেভেলপমেন্টস লিমিটেড।

বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ ভারত, মিয়ানমার ও ইউরেশীয়—এই তিন সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। সিলেটের ডাউকি ফল্ট, চট্টগ্রাম–টেকনাফের চিটাগং-আরাকান ফল্ট এবং মিয়ানমারের সাগাইং ফল্ট মিলিয়ে দেশটি অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। দ্রুত নগরায়ণ, জনসংখ্যার ঘনত্ব, বিল্ডিং কোড উপেক্ষা এবং সংকীর্ণ সড়ক পরিস্থিতি ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধারকাজকে আরও জটিল করে তুলছে। গত ১০০ বছরে বাংলাদেশে ২০০টির বেশি ভূমিকম্প রেকর্ড হয়েছে এবং ২০২৪ সালের পর থেকে কম্পনের হার আরও বেড়েছে।

সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা বলেন, সময়মতো সঠিক প্রস্তুতির মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ক্ষতি ও প্রাণহানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। তারা জরুরি করণীয় হিসেবে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে বাস্তবায়ন ও অনুমোদন প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজেশন, পুরোনো ভবনের রেট্রোফিটিং ও স্ট্রাকচারাল অডিট, অন্তত ৫০টি নতুন আধুনিক সিসমিক স্টেশন স্থাপন, জিওইনফরমেশন সিস্টেম ও এআইভিত্তিক ঝুঁকি মডেলিং, উদ্ধারকারী বাহিনীকে আধুনিক সরঞ্জাম প্রদান, স্কুল-কলেজ-অফিসে নিয়মিত ভূমিকম্প মহড়া বাধ্যতামূলক করা, মানসম্পন্ন নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার এবং রিয়েল এস্টেট খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তাদের মতে, জাপান নিয়ম মেনে কাজ করে ভূমিকম্প-সহনশীল শহর গড়তে সক্ষম হয়েছে, বাংলাদেশও চাইলে ক্ষতি অন্তত ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে।

আরও পড়ুন: দেশে নতুন ফাটলরেখা শনাক্ত: বাড়ছে ভূমিকম্প শঙ্কা

সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন জাপানের দুই ভূমিকম্প-সহনশীল স্থাপত্য বিশেষজ্ঞ কেসিরো সাকো ও হেসাইয়ে সুগিয়ামা। তারা জাপানের ভূমিকম্প-পরবর্তী অভিজ্ঞতা, নিরাপদ অবকাঠামো নকশা এবং আধুনিক টেকসই নির্মাণমান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন। এছাড়া বক্তব্য রাখেন খ্যাতিমান প্রকৌশলী প্রফেসর ড. এম শামীম জেড বসুনিয়া, প্রফেসর ড. সৈয়দ ফখরুল আমিন (বুয়েট), রিহ্যাব প্রেসিডেন্ট ওয়াহিদুজ্জামান, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী, রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লাহ আল হোসেন চৌধুরী রিজভী, প্রফেসর ড. রাকিব আহসান (বুয়েট), বাজুস প্রেসিডেন্ট এনামুল হক খান, বিএমইডির পরিচালক মমিনুল ইসলাম, স্থপতি আরিফুল ইসলাম, স্থপতি রফিক আজম ও ভিস্তারার এমডি মুস্তফা খালিদ পলাশ।

জেসিএক্স ডেভেলপমেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইকবাল হোসেন চৌধুরী স্বাগত বক্তব্যে বলেন, সম্প্রতি ঢাকায় অনুভূত একাধিক ভূমিকম্প দেশের ঝুঁকি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। দ্রুত নগরায়ণ, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং দুর্বল ভবন কাঠামোর কারণে বড় কোনো ভূমিকম্প ঘটলে বিপর্যয় ভয়াবহ হতে পারে। তিনি বলেন, রাষ্ট্র, আবাসন খাত ও জনগণ—এই তিনটি স্তম্ভ শক্তিশালী হলেই আমরা ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারব। সময় খুবই কম, আজই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বক্তারা একমত হন যে সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ের সমন্বিত উদ্যোগই পারে একটি ভূমিকম্প-সহনশীল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ, বিদ্যমান ভবনের স্ট্রাকচারাল অডিট, কাজের মান কঠোরভাবে তদারকি, জরুরি উদ্ধার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কার্যকর প্রাথমিক সতর্কবার্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি নাগরিকদের নিয়মিত ড্রিল, সচেতনতা কার্যক্রম এবং পরিবারভিত্তিক জরুরি প্রস্তুতির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।