জাপানের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি

ছবি: সংগৃহীত
জাপানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন কট্টর রক্ষণশীল রাজনীতিক সানায়ে তাকাইচি (৬৪)।
মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)-এর এই নেত্রী নিম্ন ও উচ্চ—দুই কক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন।
নিম্নকক্ষের ৪৬৫ আসনের মধ্যে তাকাইচি পান ২৩৭ ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেটিক পার্টি অব জাপানের ইউশিহিকো নোদা পান ১৪৯ ভোট। উচ্চকক্ষে তাকাইচি পান ১২৫ ভোট—যা প্রয়োজনীয় সংখ্যার চেয়ে একটি বেশি। প্রথম ধাপে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় রান-অফ ভোট ছাড়াই তিনি জাপানের ১০৪তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
এভাবে জাপানের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পদে পৌঁছে ইতিহাস গড়লেন ‘আয়রন লেডি’খ্যাত এই রাজনীতিক, যিনি একসময় দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাকাইচি পার্লামেন্টে অনুমোদন পাওয়ার পর সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
তাকাইচির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পথটি ছিল নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে। চলতি মাসের শুরুতে তিনি ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) নেতা নির্বাচিত হন। কিন্তু তার নেতৃত্বাধীন জোট সরকার থেকে দীর্ঘদিনের শরিক কোমেইতো পার্টি তহবিল কেলেঙ্কারি ও রক্ষণশীল নীতিগত অস্বস্তির কারণে সরে দাঁড়ালে সরকার রাজনৈতিক সংকটে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে তাকাইচি নতুন করে জোট গঠনের উদ্যোগ নেন।
সোমবার (২০ অক্টোবর) এলডিপি ও জাপান ইনোভেশন পার্টি (জেআইপি) আনুষ্ঠানিকভাবে জোট চুক্তি স্বাক্ষর করে।
এই চুক্তির মধ্য দিয়েই তাকাইচির প্রধানমন্ত্রী হওয়া প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। যদিও তখনও শঙ্কা ছিল—দুই দলের ভোট মিলিয়েও তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য আরও দুটি ভোট প্রয়োজন হতে পারে। শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবারের ভোটে তিনি সেই বাধা পেরিয়ে জয়ী হন।
আরও পড়ুন: হয় চুক্তি নয়তো ১৫৫% শুল্ক, চীনকে হুঁশিয়ারি ট্রাম্পের
তবে নির্বাচনের পরপরই জোটের শরিক জেআইপি মন্ত্রিসভায় যোগ না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে তাকাইচি এখন নতুন মন্ত্রিসভা গঠনে সময় নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী প্রায় পুরো সময় জাপানের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারকারী এলডিপি গত কয়েক বছরে ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। ঘন ঘন কেলেঙ্কারি, অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও রাজনৈতিক বিভাজনে দলটি এখন অস্থির সময় পার করছে।
এই অবস্থায় তাকাইচির মতো রক্ষণশীল, চীনবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিককে নেতৃত্বে আনার সিদ্ধান্তকে অনেক বিশ্লেষক এলডিপির একপ্রকার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন। কারণ, নারী নেতৃত্বের এই ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে অনেক তরুণী জাপানি নারী ইতিবাচকভাবে দেখলেও, কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে রক্ষণশীল তাকাইচি নারীর অধিকার ও সামাজিক সমতার ইস্যুতে কার্যকর পরিবর্তন আনবেন কি না।
বিবিসির প্রতিবেদনে কিছু তরুণী বলেছেন, তাকাইচির রাজনৈতিক মতাদর্শ খুঁজে দেখলে দেখা যায়, তিনি বরং পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই টিকিয়ে রাখতে চান।
সাবেক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি একসময় ছিলেন হেভি মেটাল ব্যান্ডের ড্রামার। পরে রাজনীতিতে এসে ধীরে ধীরে এলডিপির প্রভাবশালী রক্ষণশীল ধারা তৈরি করেন। তার রাজনৈতিক নায়ক যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার, যার অনুসরণে তাকাইচি জাপানের ‘আয়রন লেডি’ উপাধি পান।
তাকাইচি বলেছেন, আমি জাপানের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে চাই। এমন একটি দেশ গড়তে চাই যেখানে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিশ্চিন্তে বাঁচতে পারবে। তিনি নারীদের স্বাস্থ্য-সচেতনতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং জাপানের বৈদেশিক প্রভাব পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তাকাইচি এমন এক সময়ে ক্ষমতা গ্রহণ করছেন, যখন জাপানকে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মনে করা হচ্ছে। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তিনি এখন একটি সংখ্যালঘু জোট সরকারের নেতৃত্ব দেবেন। আগামী সপ্তাহেই তার সামনে বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ—মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্ধারিত টোকিও সফর।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এলডিপির এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত জাপানের রাজনীতিতে নতুন দিক খুলে দিলেও, তাকাইচির নেতৃত্ব টেকসই হবে কি না, তা নির্ভর করবে তার জোট ধরে রাখার দক্ষতা ও অর্থনৈতিক সংস্কারের বাস্তবায়নের ওপর।
জাপানে নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ দীর্ঘদিন ধরেই সীমিত। সংসদে নারীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, এবং দেশের রাজনীতিতে পুরুষের আধিপত্য সুস্পষ্ট। তাই সানায়ে তাকাইচির প্রধানমন্ত্রী হওয়া শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়—এটি জাপানের সমাজে লিঙ্গ সমতার প্রতীকী অগ্রগতি হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
তবু বিশ্লেষকরা বলছেন, তাকাইচি যদি তার রক্ষণশীল রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যেও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি বাস্তবায়ন করতে পারেন, তবে তিনি শুধু জাপানের নয়, বিশ্বের রাজনীতিতে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।
সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি, কিয়োডো নিউজ, জাপান টাইমস
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি