লালনকন্যা স্মরণানুষ্ঠানে চুল কেটে প্রতিবাদ

ছবি: সংগৃহীত
সদ্য প্রয়াত কিংবদন্তি লালনগীতি শিল্পী ফরিদা পারভীনের স্মরণে ময়মনসিংহে আয়োজিত এক ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শিল্প-সংস্কৃতির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া চুল কেটে দেওয়ার বর্বর ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদও জানানো হয়।
শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ভোর ৬টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত নগরের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন উদ্যান সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদপাড়ের বরইতলায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘পরম্পরা’র উদ্যোগে এই আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই সংগঠনের সভাপতি ও কবি শামীম আশরাফের চুল কেটে প্রতীকী প্রতিবাদ জানানো হয়।
সম্প্রতি ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কাশিগঞ্জ বাজার এলাকায় হালিম উদ্দিন আকন্দ নামে এক ফকিরকে জোর করে চুল ও দাড়ি কেটে দেওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সেই ভিডিও দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
অনুষ্ঠানের ব্যানারে লেখা ছিল, “আল্লাহ তুই দেহিস: মাজার ভাঙার সংস্কৃতিতে আঘাত, মানুষের ওপর অত্যাচারকারীদের ঘৃণা।”
আয়োজক শামীম আশরাফ বলেন, এই আয়োজনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাই। আমরা দু-এক দিন ধরে একটি ঘটনা দেখছি, তিনজন মানুষ একটা মানুষকে জোর করে ধরে তার লম্বা চুল কেটে দিচ্ছে। যখন চুল কেটেই দিচ্ছে, তখন লোকটি সর্বশেষ কথা বলে দিচ্ছেন, ‘হে আল্লাহ, তুই দেহিস’। এই ‘দেহিস’-এর ভেতর দিয়েই আমরা প্রতিবাদ জানাই। মাজার সংস্কৃতির ওপর যারা আঘাত করছে, শিল্প-সংস্কৃতির মানুষের ওপর যে অত্যাচার করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট।
ফরিদা পারভীনের স্মরণে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে বরইগাছের মাঝে তার ছবি দিয়ে লেখা হয়, “আমি অপার হয়ে বসে আছি।” গাছের ডালে ঝুলছিল লালনের জনপ্রিয় গানের লাইন—“মিলন হবে কত দিনে”, “জাত গেল জাত গেল বলে”, “সময় গেলে সাধন হবে না”।
গাছের নিচে সাদা কাপড় পেতে শিল্পীরা লালনগীতি পরিবেশন করেন। তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন: লোকসঙ্গীতের আকাশে নক্ষত্রপতন, চলে গেলেন ফরিদা পারভীন
গবেষক স্বপন ধর বলেন, যতবার যত ধরনের সংকীর্ণ চিন্তাধারা এসেছে, সবকিছুকে জলের মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে মানবতাবাদ। লালন অনুসারীদের আমরা পাগল বলি। এই পাগলেরা আর যা–ই করুক, ঘুষ খায় না, মিথ্যা বলে না এবং নিজেদের বিলিয়ে দেয় না।
তিনি আরও বলেন, মানুষ যদি জন্ম না নিত, তাহলে পৃথিবীর সবটাই বিফলে যেত। আগে মানুষ জন্ম নিয়েছে, তারপর নানা মতভেদ হয়েছে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সুর্গত তালুকদার, যিনি বলেন, লালনকন্যা ফরিদা পারভীনের প্রয়াণে জাতি মর্মাহত। বিশ্বের দরবারে লালনগীতিকে তিনিই তুলে ধরেছিলেন। পরম্পরার আজকের আয়োজন খুবই সুন্দর।
শিল্পী খাইরুল ইসলাম বলেন, লালনের গান নিয়ে সারা বিশ্বে আজ যে চর্চা হচ্ছে, সেই গানকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন কিংবদন্তি শিল্পী ফরিদা পারভীন। তার প্রয়াণের পর আজ তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। এই দেশের সুর ও সংগীতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা তরুণ প্রজন্ম সারা দেশে একসঙ্গে কাজ করব।
গান শুনতে আসা দর্শক জয়া বর্মণ বলেন, পার্কে ঘুরতে এসে এই আয়োজন দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আমরা চাইব, লালনের গান আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে থাকুক। লালনের গানে জাতের ফারাক ছিল না। লালনের গানকে ফরিদা পারভীন যেভাবে তুলে ধরেছিলেন, তরুণ প্রজন্ম যেন যুগে যুগে এটি ছড়িয়ে দেয়।
শামীম আশরাফ বলেন, শিল্প-সংস্কৃতির নগরী ময়মনসিংহ। মাজার সংস্কৃতি, শিল্প-সংস্কৃতি ও নানাবিধ মানুষের ওপর যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে, এসব নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন। ফরিদা পারভীনের মতো এত বড় মানুষের প্রয়াণে সারা দেশে কোনো আয়োজন হয়নি। তাই তাকে স্মরণ করে আমরা ছোট একটি আয়োজনের চেষ্টা করেছি।
প্রসঙ্গত, ফরিদা পারভীন গত ১৩ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন। তিনি লালনগীতির জন্য সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন এবং ‘লালনকন্যা’ বা ‘লালন সম্রাজ্ঞী’ নামে পরিচিত ছিলেন।
এই আয়োজন শুধু একটি স্মরণসভা নয়, বরং এটি ছিল শিল্প-সংস্কৃতি, মানবতাবাদ ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পক্ষে এক দৃঢ় অবস্থান। ‘পরম্পরা’র এই উদ্যোগ ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দিয়েছে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি