ফরিদা পারভীনের শেষ শ্রদ্ধা শহীদ মিনারে, দাফন কুষ্টিয়ায়

ছবি: সংগৃহীত
দেশের কিংবদন্তি লালনসংগীত শিল্পী ফরিদা পারভীন দীর্ঘ অসুস্থতার পর শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাত ১০টা ১৫ মিনিটে রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর।
ফরিদা পারভীন দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতা, ডায়াবেটিসসহ নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। কিডনি বিকল হওয়ায় সপ্তাহে দুই দিন তাকে ডায়ালাইসিস করাতে হতো। চলতি বছরের ২ সেপ্টেম্বর ডায়ালাইসিসের জন্য তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। ডায়ালাইসিসের পর তার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হলে চিকিৎসকরা তাকে আইসিইউতে ভর্তি করেন এবং ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। চিকিৎসকদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সময় ছয় সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড তার চিকিৎসার দায়িত্বে ছিল।
ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ কুমার চক্রবর্তী জানান, ফরিদা পারভীন দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন এবং পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করা ছাড়া উপায় ছিল না।
শিল্পীর পরিবারের সদস্যরা জানান, মরদেহ রাতেই তেজগাঁওয়ে বাড়িতে নেওয়া হবে। এরপর রবিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য রাখা হবে। এক ঘণ্টা শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বেলা ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর মরদেহ কুষ্টিয়ায় নেওয়া হবে এবং শিল্পীর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী বাবা-মায়ের কবরের পাশে কুষ্টিয়া পৌর কবরস্থানে দাফন করা হবে।
শিল্পীর ছেলে ইমাম নিমেরি উপল বলেন, মাকে আমরা কুষ্টিয়ায় দাফন সম্পন্ন করব, তার ইচ্ছা অনুযায়ী।
মেয়ে জিহান ফারিয়া বলেন, মা মর্যাদা নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তার শেষ ইচ্ছে ছিল কুষ্টিয়া যাওয়ার।
আরও পড়ুন: লোকসঙ্গীতের আকাশে নক্ষত্রপতন, চলে গেলেন ফরিদা পারভীন
শিল্পীর স্বামী, প্রখ্যাত বংশীবাদক ওস্তাদ গাজী আব্দুল হাকিম, সাংবাদিকদের জানান, সকাল সাড়ে ৯টায় তেজকুনি পাড়া মসজিদে শিল্পীর প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর শিল্পী ও কলাকুশলীসহ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা প্রদানের জন্য মরদেহ সকাল সাড়ে ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাড়ে ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। আনুষ্ঠানিকতা শেষে মরদেহ কুষ্টিয়াতে নেওয়া হবে।
ফরিদা পারভীনের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শোক জানিয়েছেন।
ফরিদা পারভীন ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়া থানায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার পেশাদার সংগীতজীবন শুরু হয়। বাবা-মায়ের উৎসাহে এবং দাদির গান পরিবেশনায় বেড়ে ওঠা ফরিদা পারভীন গান জগতে প্রবেশ করেন রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে ১৯৬৮ সালে। ১৯৭৩ সালে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। পরে সাধক মোকসেদ আলী শাহর কাছে লালনগীতির তালিম নেন এবং ধীরে ধীরে লালনগীতির জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
তিনি দীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে গানে কাটিয়েছেন। জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’, ‘তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদির নাম’, ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’। শ্রোতারা তাকে ‘লালনকন্যা’ উপাধি দিয়েছিলেন।
ফরিদা পারভীন ১৯৮৭ সালে লালনসংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিতে একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়া ১৯৯৩ সালে ‘অন্ধ প্রেম’ চলচ্চিত্রের ‘নিন্দার কাঁটা’ গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পী, নারী) এবং ২০০৮ সালে জাপানের ফুকুওয়াকা পুরস্কার লাভ করেন। তিনি লালনসংগীতকে দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচার করেছেন; জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বহু দেশে লালনসংগীত পরিবেশন করেছেন।
শিল্পীর শিক্ষাজীবন শুরু মাগুরায়। একাধিক স্কুলে পড়াশোনা শেষে কুষ্টিয়ার মীর মশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস, ১৯৭৪ সালে কুষ্টিয়া গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি এবং স্নাতক শেষ করেন। বাবার চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় যেতে হয়েছে তাকে।
ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে আধুনিক ও দেশের গানও জনপ্রিয় হয়। তিনি দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে লালন সাঁইয়ের বাণী ও সুরকে জনপ্রিয় করে গেছেন, এবং তা বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিয়েছেন।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি