রাজবাড়ীতে কবর থেকে নুরাল পাগলের মরদেহ তুলে আগুন
ছবি: সংগৃহীত
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলকে ঘিরে ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
শুক্রবার (০৫ সেপ্টেম্বর) জুমার নামাজের পর এ ঘটনা ঘটে।
দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর উত্তেজিত তৌহিদী জনতা কবর ভেঙে নুরাল পাগলের মরদেহ তুলে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পদ্মার মোড়ে এনে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন, হাসপাতালে নেয়ার পথে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। আহতদের মধ্যে ছয়জন পুলিশ সদস্যও রয়েছেন।
জুমার নামাজের পরপরই গোয়ালন্দ আনসার ক্লাব মাঠে তৌহিদী জনতার ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে মিছিল বের হয়ে নুরাল পাগলের দরবার শরীফের দিকে যায়। তারা দরবারে ঢুকে ভাঙচুর চালায় ও অগ্নিসংযোগ করে।
এ সময় নুরাল পাগলের ভক্ত ও অনুসারীরা পাল্টা প্রতিরোধে নামলে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বাধে। ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও লাঠিসোটা ব্যবহারে অন্তত শতাধিক মানুষ আহত হন।
সংঘর্ষের মধ্যে উত্তেজিত জনতা দরবার শরীফে ঢুকে পড়ে ভেতরে লুটপাট চালায়। পরে তারা বিশেষ কাঠামোর ভেতরে সমাধিস্থ নুরাল পাগলের কবর ভেঙে মরদেহ বের করে ফেলে। মরদেহ নিয়ে তারা মহাসড়কে মিছিল করে এবং পরে সেটিতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
স্থানীয়রা জানান, সংঘর্ষে আহত হয়ে অন্তত ২২ জন গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯ জনকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
পথে দুজন মারা যান বলে রাজবাড়ীর সিভিল সার্জন ডা. এস. এম. মাসুদ নিশ্চিত করেছেন।
আরও পড়ুন: ঝিনাইদহে নিজের লাইসেন্স করা বন্দুকের গুলিতে ব্যবসায়ীর মৃত্যু
তিনি আরও জানান, আহতদের মধ্যে তিনজন নিজেরাই ফরিদপুর মেডিকেলে চলে গেছেন। বর্তমানে স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসন সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
পুলিশ জানায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গেলে উত্তেজিত জনতা পুলিশের ওপরও হামলা চালায়। পুলিশের দুটি গাড়ি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এতে ছয়জন পুলিশ সদস্য আহত হন।
হামলার সময় সেনাবাহিনী, র্যাব ও অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলেও প্রথম দিকে জনতার আক্রমণের মুখে তারা সরে যেতে বাধ্য হন। পরে বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে সেনাবাহিনী, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও র্যাব যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা দরবারে লাগানো আগুন নেভানোর চেষ্টা চালান।
গোয়ালন্দ ঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রাকিবুল ইসলাম ছয় পুলিশ সদস্য আহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে তিনি এর বাইরে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জেলা পুলিশ সুপার মো. কামরুল ইসলাম ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ আল রাজীব ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন, তবে তারাও মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
রাজবাড়ীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) মো. শরীফ আল রাজীব সন্ধ্যায় জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দোষীদের শনাক্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আশির দশকের শেষের দিকে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগল গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে নিজ বাড়িতে দরবার শরীফ প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজেকে ইমাম মাহদী দাবি করে আলোচনায় আসেন। এতে তীব্র জনরোষ তৈরি হলে ১৯৯৩ সালের ২৩ মার্চ তিনি মুচলেকা দিয়ে এলাকা ত্যাগ করেন। তবে কিছুদিন পর তিনি ফের ফিরে এসে দরবারের কার্যক্রম চালাতে থাকেন।
গত ২৩ আগস্ট ভোরে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নুরাল পাগল। সেদিন সন্ধ্যায় প্রথম জানাজা শেষে রাতে দরবার শরীফের ভেতরে দ্বিতীয় জানাজার পর বিশেষ কাঠামোর ভেতরে প্রায় ১২ ফুট উঁচু স্থানে তাকে দাফন করা হয়। কবরটিকে কাবা শরীফের আদলে রঙ করা হয় এবং ‘হযরত ইমাম মাহদী (আ.) দরবার শরীফ’ লেখা ব্যানার টাঙানো হয়।
এ ঘটনার পর থেকেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে দাবি করে আন্দোলনে নামে তৌহিদী জনতা ও আলেম সমাজ। তারা দাবি তোলে—কবরের রঙ পরিবর্তন, সাইনবোর্ড অপসারণ এবং কবর নিচে নামাতে হবে। প্রথম দুটি দাবি মেনে নিলেও নুরাল পাগলের পরিবার কবরের উচ্চতা স্বাভাবিক করতে সময় চাইলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
পরে প্রশাসনের মধ্যস্থতায় কয়েক দফা বৈঠক হয়। তৌহিদী জনতা সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেয়। অবশেষে শুক্রবারের বিক্ষোভ সমাবেশ থেকেই সহিংসতায় রূপ নেয় পরিস্থিতি।
ঘটনার পর গোয়ালন্দজুড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সেনা সদস্য ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
প্রশাসন জানিয়েছে, এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি








